বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং ও আমাদের উচ্চশিক্ষার বাস্তবতা

এ কে এম শাহনাওয়াজ

সম্প্রতি ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ২০২৩’ প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না, সেখানে একটু আশার আলো দেখা গেছে। এবার বিশ্বের ৬০১ থেকে ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় উঠে এসেছে। এর একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যটি বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১২০০ থেকে ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে বুয়েট, কুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর পরের ধাপ আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হয় না।

উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বিভিন্ন সময়েই হতাশা প্রকাশ করছি আমরা। শুধু উচ্চশিক্ষা কেন, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অতঃপর এমফিল, পিএইচডির মতো উচ্চতর গবেষণা সব ব্যাপারেই আমাদের নানা মহলের অস্বস্তি রয়েছে। সরল চোখে বাস্তবতার উঠানে দাঁড়িয়ে হতাশ হওয়ার পেছনে প্রামাণ্য তথ্যও দেয়া যাবে। তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে প্রকৃত সংকট নির্দেশ করে যদি সমালোচনা বা হতাশা ব্যক্ত করি এবং সংকটের কারণ অনুধাবন করি তাহলে এর প্রতিবিধানের পথ পাওয়া সহজ। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গভীর পর্যবেক্ষণ ছাড়া খণ্ডিত সত্যে দাঁড়িয়ে দায়িত্বশীল জায়গা থেকে হালকা সমালোচনার একটি প্রচলন দেখা যায়। এতে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়, অন্যদিকে দেশবাসীর সামনে ছড়িয়ে দেয়া হয় নেতিবাচক ধারণা।

সম্ভবত বছর তিনেক আগে বর্তমান সরকারের একজন সুশিক্ষিত মন্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করা এমফিল, পিএইচডি থিসিসের মান নিয়ে ঢালাওভাবে সমালোচনা করলেন। আমি জানি না, কত বছর ধরে তিনি কোন রিভিউ সেলে শত শত থিসিস মূল্যায়ন করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। কারণ আমরা অনেক সময় দেখছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসম্মত থিসিস করার কারণে বেশ কয়েকজন গবেষক উচ্চতর গবেষণার জন্য বিশ্বের নামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি সম্পন্ন করা থিসিস বই হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতের একটি স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে সম্মাননা পেয়েছে। সে সময় এ ধারার সাধারণীকরণ করা মন্তব্য আমাদের হতাশ করে বৈকি!

তবে নেতিবাচক সমালোচনার আগে এই সত্যটি সামনে আসতে হবে যে, শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার জন্য যে পরিবেশ ও প্রণোদনা প্রয়োজন তার সামান্য সংস্থানও রাষ্ট্র করতে পারছে কি না। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নামে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও এর আর্থিক সংস্থান ইউজিসির মাধ্যমে রাষ্ট্রই করে থাকে। তাই প্রশ্ন আসে, শিক্ষা-গবেষণার মানোন্নয়নে সরকার কী পৃষ্ঠপোষকতা দেয়?

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন শুধু একাডেমিক কারিকুলাম আর পাঠদানের ওপর নির্ভর করে না। এই ভুবনে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানসৃষ্টির দায়িত্ব পালন করতে হয়। বায়বীয়ভাবে জ্ঞান সৃষ্টি করা যায় না। এর জন্য শিক্ষক-গবেষকদের আর্থিকসহ গবেষণাসহায়ক নানা রকম সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এর সংস্থানও প্রধানত রাষ্ট্রই করে থাকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণার পথ কুসুমাস্তীর্ণ থাকে না।

কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা গবেষণা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা বিদেশি খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, গবেষকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সেমিনার করতে চান তাহলে আর্থিক সহায়তা নিয়ে রাষ্ট্র পাশে দাঁড়ায় না। অথচ এসব আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই করার কথা। এর পরও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট কমিটি জানে, সেমিনারের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেয়ার জন্য কী দুঃসহ সময় কাটাতে হয়।

এসব বাস্তবতার কারণে গবেষণার দ্বার উন্মোচন করা এ দেশে খুব কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণার মান নিয়ে যখন সরকারি নীতিনির্ধারকরা প্রশ্ন তোলেন তখন বলতে ইচ্ছা করে অল্প তেলে কীভাবে আপনারা প্রতিদিন মচমচে ভাজা খেতে চান? মনে পড়ে সে সময় জাতীয় দৈনিকে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম-‘পুকুর খনন দেখতে ১৬ কর্মকর্তা, ব্যয় হবে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।’ বিদেশ ভ্রমণের এসব শিরোনামে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এমন নানা হাস্যকর কাজে প্রায়ই এ দেশে সরকারি টাকা হরিলুট হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায়। আমরা অসহায়ের মতো শুধু আফসোস করে হিসাব কষি-‘আহা, এই বরাদ্দে দেশের অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলন করতে পারত।’ শুনতে ভালো লাগত, দেশের সুশিক্ষিত মন্ত্রীরা যদি কখনো বলতেন এসব অপচয় না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা করি। দেখুন না, মানসম্মত গবেষণা করার কত মেধা রাখে এ দেশের গবেষকরা!

একটি অপচর্চা প্রায়শই দেখা যায়, মানসম্মত গবেষণা হচ্ছে না দেখে হাপিত্যাশ করা হয়, কিন্তু প্রতিবন্ধকতাগুলো তো বিচার করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা করতে আসা সরকারি কলেজ শিক্ষকরা অনেক যুদ্ধ করেই এ কাজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পাওয়া অনেক হাঙ্গামার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বারবার ছুটতে হয় শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে। যেন কোনো অপকর্ম করতে চাচ্ছেন তারা। অল্প কয়েকজন হয়তো ইউজিসির বৃত্তি পান। অধিকাংশ পকেটের পয়সা খরচ করে গবেষণা করেন। বাংলাদেশের নানা প্রান্তের কলেজে এ শিক্ষকরা পড়ান। পকেটের পয়সা খরচ করে তত্ত্বাবধায়কের কাছে আসেন। ছুটিছাঁটা নিয়েও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। অর্থ ও ছুটির অভাবে সব সময় তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি, আর্কাইভ এবং অন্তত প্রতিবেশী দেশের তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গেও নিজেদের যুক্ত করতে পারেন না। এর পরও তারা তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে যা করেন একেও আমরা কম বলতে পারি না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষকদেরও ভোগান্তি কম নয়। গবেষণা করা যেন এদের অপরাধ। হাজার উদাহরণ থেকে একটি উদাহরণ আমি দিতে চাই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আমার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা করছিলেন। তিনি গবেষণা করছেন মধ্যযুগের বাংলার স্থাপত্যে পাথরের অলঙ্করণ নিয়ে। নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই গবেষণা করতে হয়েছে তাকে। ফিল্ডওয়ার্কে তাকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রত্নস্থল, জাদুঘর ও লাইব্রেরিতে একাধিকবার যেতে হয়েছে। শেষ বেলায় এসে বিপদে পড়েছেন। আমাদের জাতীয় জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত জাদুঘরগুলোতে ব্রিটিশ যুগের একটি নিয়ম চালু রেখেছে। এখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ অচল। জাদুঘর পরিদর্শনে গেলে প্রথমেই জানিয়ে দেয়া হয় ছবি তোলা যাবে না। এতে কী ক্ষতি হবে তারা অবশ্য বলতে পারেন না। ভারত বাদে সারা দুনিয়ায় জাদুঘরের প্রদর্শিত বস্তু ছবি তোলার জন্য উন্মুক্ত। বিশ্ববিখ্যাত প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘর ও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আমি প্রাণভরে ছবি তুলেছি। আর গবেষকদের জন্য তো এরা উন্মুক্ত করে দেয় প্রদর্শিত ও অপ্রদর্শিত ভাণ্ডার।

এখন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার গবেষক ছাত্র বারবার প্রতিহত হয়েছিলেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায়। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, আমাদের জাদুঘরগুলোতে বিশেষ করে জাতীয় জাদুঘরে যা প্রদর্শিত থাকে তারচেয়ে অনেক বেশি প্রত্নবস্তু গুদামজাত আছে। একজন গবেষক তো এসব পরীক্ষা করেই মূল্যায়ন করবেন। যেখানে প্রদর্শিত প্রত্নবস্তুর ছবি তোলাই নিষেধ সেখানে স্বাভাবিকভাবে বাকি সব দেখার অধিকার রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু এসব বিশ্লেষণ করতে না পারলে গবেষণা পূর্ণতা পাবে কেমন করে? জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে চিঠি দিয়েছিলাম সহযোগিতার জন্য। আমাদের এ ধরনের চিঠি নিয়ে অনেক গবেষক ইউরোপ-আমেরিকায় গবেষণার অবাধ সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু এ দেশে সম্ভব নয়। আমার চিঠি পাওয়ার পর জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সামান্য দয়া হয়েছিল। তারা প্রত্নবস্তু দেখাতে পারবেন না, কিন্তু পয়সার বিনিময়ে কিছু ছবি বিক্রি করতে পারবেন। এর আর্থিক মূল্যও নিতান্ত কম নয়। কিন্তু এ সব হর্তাকর্তার কী করে বোঝানো যাবে যে ছবি দেখে গবেষণা হয় না। গবেষক নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করবেন ও নানা আঙ্গিক থেকে ছবি তুলবেন। আমার তত্ত্বাবধানে থাকা সেই গবেষক সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তা হলে প্রশ্ন আসে- এত প্রতিবন্ধকতার মুখে দাঁড়িয়ে একজন গবেষক কীভাবে গবেষণায় কাঙ্ক্ষিত মান উপস্থাপন করতে পারবেন? গবেষণা করতে গিয়ে এ ধরনের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়।

বছর তিনেক আগে ইংল্যান্ডে কিছুদিনের জন্য ছিলাম। এ সময় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ডারহামে একজন অধ্যাপক বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন-‘তোমাদের দেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য শিক্ষকদের চেয়ে ব্যুরোক্র্যাটরা বেশি আসে। অন্য সব দেশে এ প্রবণতা খুব কম।’ আমি বললাম, ‘দেখ, ইংল্যান্ডে পড়তে এলে এখন ফান্ড পাওয়া কঠিন। শিক্ষকরা নিজ দেশে সরকারের কাছ থেকে তেমন আর্থিক সহযোগিতা পান না। কিন্তু সরকারি আমলাদের ক্ষেত্রে নানা রকম ফান্ড আছে। তাই তারা আসতে পারেন।’ অধ্যাপকের পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিল না। তিনি বললেন-‘সুযোগ তো বেশি পাওয়ার কথা শিক্ষকদের। তারা তাদের গবেষণার অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দেবেন ছাত্র ও গবেষকদের কাছে। আর সরকারি কর্মকর্তার সেই সুযোগ কম। তারা নানা দপ্তরে কাজ করবেন। সেখানে তার গবেষণার অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ অনেক কম।’

এসব সত্য আমরা তলিয়ে দেখি না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে নিত্য মুখরোচক বিবৃতি দিতে থাকি। এ কথা তো সত্যি এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত মান ধরে রাখতে পারছে না। কিন্তু এর পেছনের কারণগুলো সব সময় বিবেচনায় আনি না। আমি আমার শিক্ষক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। আজ অভিজ্ঞতা থেকে দায়িত্ব নিয়ে বলব, রাজনৈতিক আছর মুক্ত রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ যদি ফিরে পাওয়া যায়, শিক্ষা-গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেয়া হয়, তা হলে অবশ্যই বিশ্বমানের গবেষণা এ দেশে থেকেই করা সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং ও আমাদের উচ্চশিক্ষার বাস্তবতা

এ কে এম শাহনাওয়াজ

সম্প্রতি ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ২০২৩’ প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না, সেখানে একটু আশার আলো দেখা গেছে। এবার বিশ্বের ৬০১ থেকে ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় উঠে এসেছে। এর একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যটি বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১২০০ থেকে ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে বুয়েট, কুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর পরের ধাপ আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হয় না।

উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বিভিন্ন সময়েই হতাশা প্রকাশ করছি আমরা। শুধু উচ্চশিক্ষা কেন, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অতঃপর এমফিল, পিএইচডির মতো উচ্চতর গবেষণা সব ব্যাপারেই আমাদের নানা মহলের অস্বস্তি রয়েছে। সরল চোখে বাস্তবতার উঠানে দাঁড়িয়ে হতাশ হওয়ার পেছনে প্রামাণ্য তথ্যও দেয়া যাবে। তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে প্রকৃত সংকট নির্দেশ করে যদি সমালোচনা বা হতাশা ব্যক্ত করি এবং সংকটের কারণ অনুধাবন করি তাহলে এর প্রতিবিধানের পথ পাওয়া সহজ। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গভীর পর্যবেক্ষণ ছাড়া খণ্ডিত সত্যে দাঁড়িয়ে দায়িত্বশীল জায়গা থেকে হালকা সমালোচনার একটি প্রচলন দেখা যায়। এতে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়, অন্যদিকে দেশবাসীর সামনে ছড়িয়ে দেয়া হয় নেতিবাচক ধারণা।

সম্ভবত বছর তিনেক আগে বর্তমান সরকারের একজন সুশিক্ষিত মন্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করা এমফিল, পিএইচডি থিসিসের মান নিয়ে ঢালাওভাবে সমালোচনা করলেন। আমি জানি না, কত বছর ধরে তিনি কোন রিভিউ সেলে শত শত থিসিস মূল্যায়ন করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। কারণ আমরা অনেক সময় দেখছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসম্মত থিসিস করার কারণে বেশ কয়েকজন গবেষক উচ্চতর গবেষণার জন্য বিশ্বের নামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি সম্পন্ন করা থিসিস বই হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতের একটি স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে সম্মাননা পেয়েছে। সে সময় এ ধারার সাধারণীকরণ করা মন্তব্য আমাদের হতাশ করে বৈকি!

তবে নেতিবাচক সমালোচনার আগে এই সত্যটি সামনে আসতে হবে যে, শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার জন্য যে পরিবেশ ও প্রণোদনা প্রয়োজন তার সামান্য সংস্থানও রাষ্ট্র করতে পারছে কি না। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নামে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও এর আর্থিক সংস্থান ইউজিসির মাধ্যমে রাষ্ট্রই করে থাকে। তাই প্রশ্ন আসে, শিক্ষা-গবেষণার মানোন্নয়নে সরকার কী পৃষ্ঠপোষকতা দেয়?

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন শুধু একাডেমিক কারিকুলাম আর পাঠদানের ওপর নির্ভর করে না। এই ভুবনে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানসৃষ্টির দায়িত্ব পালন করতে হয়। বায়বীয়ভাবে জ্ঞান সৃষ্টি করা যায় না। এর জন্য শিক্ষক-গবেষকদের আর্থিকসহ গবেষণাসহায়ক নানা রকম সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এর সংস্থানও প্রধানত রাষ্ট্রই করে থাকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণার পথ কুসুমাস্তীর্ণ থাকে না।

কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা গবেষণা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা বিদেশি খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, গবেষকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সেমিনার করতে চান তাহলে আর্থিক সহায়তা নিয়ে রাষ্ট্র পাশে দাঁড়ায় না। অথচ এসব আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই করার কথা। এর পরও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট কমিটি জানে, সেমিনারের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেয়ার জন্য কী দুঃসহ সময় কাটাতে হয়।

এসব বাস্তবতার কারণে গবেষণার দ্বার উন্মোচন করা এ দেশে খুব কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণার মান নিয়ে যখন সরকারি নীতিনির্ধারকরা প্রশ্ন তোলেন তখন বলতে ইচ্ছা করে অল্প তেলে কীভাবে আপনারা প্রতিদিন মচমচে ভাজা খেতে চান? মনে পড়ে সে সময় জাতীয় দৈনিকে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম-‘পুকুর খনন দেখতে ১৬ কর্মকর্তা, ব্যয় হবে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।’ বিদেশ ভ্রমণের এসব শিরোনামে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এমন নানা হাস্যকর কাজে প্রায়ই এ দেশে সরকারি টাকা হরিলুট হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায়। আমরা অসহায়ের মতো শুধু আফসোস করে হিসাব কষি-‘আহা, এই বরাদ্দে দেশের অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলন করতে পারত।’ শুনতে ভালো লাগত, দেশের সুশিক্ষিত মন্ত্রীরা যদি কখনো বলতেন এসব অপচয় না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা করি। দেখুন না, মানসম্মত গবেষণা করার কত মেধা রাখে এ দেশের গবেষকরা!

একটি অপচর্চা প্রায়শই দেখা যায়, মানসম্মত গবেষণা হচ্ছে না দেখে হাপিত্যাশ করা হয়, কিন্তু প্রতিবন্ধকতাগুলো তো বিচার করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা করতে আসা সরকারি কলেজ শিক্ষকরা অনেক যুদ্ধ করেই এ কাজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পাওয়া অনেক হাঙ্গামার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বারবার ছুটতে হয় শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে। যেন কোনো অপকর্ম করতে চাচ্ছেন তারা। অল্প কয়েকজন হয়তো ইউজিসির বৃত্তি পান। অধিকাংশ পকেটের পয়সা খরচ করে গবেষণা করেন। বাংলাদেশের নানা প্রান্তের কলেজে এ শিক্ষকরা পড়ান। পকেটের পয়সা খরচ করে তত্ত্বাবধায়কের কাছে আসেন। ছুটিছাঁটা নিয়েও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। অর্থ ও ছুটির অভাবে সব সময় তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি, আর্কাইভ এবং অন্তত প্রতিবেশী দেশের তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গেও নিজেদের যুক্ত করতে পারেন না। এর পরও তারা তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে যা করেন একেও আমরা কম বলতে পারি না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষকদেরও ভোগান্তি কম নয়। গবেষণা করা যেন এদের অপরাধ। হাজার উদাহরণ থেকে একটি উদাহরণ আমি দিতে চাই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আমার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা করছিলেন। তিনি গবেষণা করছেন মধ্যযুগের বাংলার স্থাপত্যে পাথরের অলঙ্করণ নিয়ে। নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই গবেষণা করতে হয়েছে তাকে। ফিল্ডওয়ার্কে তাকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রত্নস্থল, জাদুঘর ও লাইব্রেরিতে একাধিকবার যেতে হয়েছে। শেষ বেলায় এসে বিপদে পড়েছেন। আমাদের জাতীয় জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত জাদুঘরগুলোতে ব্রিটিশ যুগের একটি নিয়ম চালু রেখেছে। এখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ অচল। জাদুঘর পরিদর্শনে গেলে প্রথমেই জানিয়ে দেয়া হয় ছবি তোলা যাবে না। এতে কী ক্ষতি হবে তারা অবশ্য বলতে পারেন না। ভারত বাদে সারা দুনিয়ায় জাদুঘরের প্রদর্শিত বস্তু ছবি তোলার জন্য উন্মুক্ত। বিশ্ববিখ্যাত প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘর ও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আমি প্রাণভরে ছবি তুলেছি। আর গবেষকদের জন্য তো এরা উন্মুক্ত করে দেয় প্রদর্শিত ও অপ্রদর্শিত ভাণ্ডার।

এখন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার গবেষক ছাত্র বারবার প্রতিহত হয়েছিলেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায়। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, আমাদের জাদুঘরগুলোতে বিশেষ করে জাতীয় জাদুঘরে যা প্রদর্শিত থাকে তারচেয়ে অনেক বেশি প্রত্নবস্তু গুদামজাত আছে। একজন গবেষক তো এসব পরীক্ষা করেই মূল্যায়ন করবেন। যেখানে প্রদর্শিত প্রত্নবস্তুর ছবি তোলাই নিষেধ সেখানে স্বাভাবিকভাবে বাকি সব দেখার অধিকার রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু এসব বিশ্লেষণ করতে না পারলে গবেষণা পূর্ণতা পাবে কেমন করে? জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে চিঠি দিয়েছিলাম সহযোগিতার জন্য। আমাদের এ ধরনের চিঠি নিয়ে অনেক গবেষক ইউরোপ-আমেরিকায় গবেষণার অবাধ সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু এ দেশে সম্ভব নয়। আমার চিঠি পাওয়ার পর জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সামান্য দয়া হয়েছিল। তারা প্রত্নবস্তু দেখাতে পারবেন না, কিন্তু পয়সার বিনিময়ে কিছু ছবি বিক্রি করতে পারবেন। এর আর্থিক মূল্যও নিতান্ত কম নয়। কিন্তু এ সব হর্তাকর্তার কী করে বোঝানো যাবে যে ছবি দেখে গবেষণা হয় না। গবেষক নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করবেন ও নানা আঙ্গিক থেকে ছবি তুলবেন। আমার তত্ত্বাবধানে থাকা সেই গবেষক সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তা হলে প্রশ্ন আসে- এত প্রতিবন্ধকতার মুখে দাঁড়িয়ে একজন গবেষক কীভাবে গবেষণায় কাঙ্ক্ষিত মান উপস্থাপন করতে পারবেন? গবেষণা করতে গিয়ে এ ধরনের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়।

বছর তিনেক আগে ইংল্যান্ডে কিছুদিনের জন্য ছিলাম। এ সময় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ডারহামে একজন অধ্যাপক বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন-‘তোমাদের দেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য শিক্ষকদের চেয়ে ব্যুরোক্র্যাটরা বেশি আসে। অন্য সব দেশে এ প্রবণতা খুব কম।’ আমি বললাম, ‘দেখ, ইংল্যান্ডে পড়তে এলে এখন ফান্ড পাওয়া কঠিন। শিক্ষকরা নিজ দেশে সরকারের কাছ থেকে তেমন আর্থিক সহযোগিতা পান না। কিন্তু সরকারি আমলাদের ক্ষেত্রে নানা রকম ফান্ড আছে। তাই তারা আসতে পারেন।’ অধ্যাপকের পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিল না। তিনি বললেন-‘সুযোগ তো বেশি পাওয়ার কথা শিক্ষকদের। তারা তাদের গবেষণার অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দেবেন ছাত্র ও গবেষকদের কাছে। আর সরকারি কর্মকর্তার সেই সুযোগ কম। তারা নানা দপ্তরে কাজ করবেন। সেখানে তার গবেষণার অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ অনেক কম।’

এসব সত্য আমরা তলিয়ে দেখি না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে নিত্য মুখরোচক বিবৃতি দিতে থাকি। এ কথা তো সত্যি এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত মান ধরে রাখতে পারছে না। কিন্তু এর পেছনের কারণগুলো সব সময় বিবেচনায় আনি না। আমি আমার শিক্ষক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। আজ অভিজ্ঞতা থেকে দায়িত্ব নিয়ে বলব, রাজনৈতিক আছর মুক্ত রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ যদি ফিরে পাওয়া যায়, শিক্ষা-গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেয়া হয়, তা হলে অবশ্যই বিশ্বমানের গবেষণা এ দেশে থেকেই করা সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়