মানসম্মত শিক্ষাক্রম ও শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করুন

শিক্ষক দিবস হলো শিক্ষকদের সম্মানে পালিত একটি বিশেষ দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন দিনে শিক্ষক দিবস পালন করে থাকে। তবে ১০০টিরও বেশি দেশ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করে। বিশ্ব শিক্ষক সংঘ তথা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় এবং ইউনেস্কো-আইএলও’র সদিচ্ছায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলনে শিক্ষকের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদাবিষয়ক সনদ ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ প্রণীত হয়। সেজন্য ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক ফ্রেডারিক এম মেয়র এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের অনুরোধে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন। এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল গঠিত হয় ১৯৯৩ সালে। এটি বেলজিয়ামভিত্তিক একটি শিক্ষা সংক্রান্ত সংস্থা।

এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো-The Transformation of education begins with teachers. অর্থাৎ, শিক্ষার রূপান্তর শুরু হয় শিক্ষকদের দিয়ে। অন্য কথায়, শিক্ষকদের দিয়ে শিক্ষার পরিবর্তন শুরু হয়। এ প্রতিপাদ্যটি শতভাগ যথার্থ। কিন্তু শিক্ষার পরিবর্তন শিক্ষকদের দিয়ে শুরু করতে হলে তাদের মান উন্নত করতে হবে। শিক্ষকের মানের উন্নতির জন্য প্রয়োজন উন্নত নিয়োগ প্রক্রিয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান, শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রভৃতি। ২০০৫ সাল থেকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৮ সাল থেকে এর আরও উন্নত সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ চলছে। ফলে বেসরকারি সেক্টর মানসম্মত শিক্ষক পেতে শুরু করছে। তাছাড়া পূর্ব থেকে শিক্ষকের মান উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে বেসরকারি শিক্ষা সেক্টর পর্যায়ক্রমে মানসম্মত হচ্ছে। কিন্তু এখন প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষাক্রম, শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করা।

আগামী বছর থেকে শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রমটি ‘শিক্ষাক্রম ২০২২’ নামে পরিচিত। কোভিড-১৯ এর কারণে যথাসময়ে শিক্ষাক্রম চালু করা যায়নি। নতুন শিক্ষাক্রমে গাঠনিক মূল্যায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে গাঠনিক মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের ২০ ভাগ জ্ঞান দান করতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে-যে ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থী কতটুকু জানতে পারল তা যাচাই করা যায়, তা হলো মূল্যায়ন। মূল্যায়ন হলো, শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন যাচাইয়ের পরিমাপক। আমাদের দেশে দুটি পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন পরিমাপ করা হয়। একটি হলো গাঠনিক মূল্যায়ন; অন্যটি সামষ্টিক মূল্যায়ন। শ্রেণি কার্যক্রম চলাকালীন শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি ও আচরণের বিভিন্নমুখী বিকাশ সম্পর্কে জানার জন্য বিষয় শিক্ষক কর্তৃক যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তা হলো গাঠনিক মূল্যায়ন। অন্য দিকে শিক্ষাবর্ষের কোনো নির্ধারিত পাঠ সমাপ্ত করে/পাঠ বন্ধ রেখে শিক্ষার্থী তার পঠিত বিষয়গুলোয় কীরূপ জ্ঞান অর্জন করেছে, তা যাচাইয়ের জন্য যে ব্যবস্থা করা হয়, তা হলো সামষ্টিক মূল্যায়ন। মূল্যায়নের জগতে সামষ্টিক মূল্যায়ন হলো শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন।

শিক্ষাক্রম ২০২২-এ বিভিন্ন শ্রেণিতে গাঠনিক মূল্যায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে প্রাকপ্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক (গাঠনিক) মূল্যায়নের নির্দেশনা রয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৭০ ভাগ শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক (গাঠনিক) মূল্যায়ন ও ৩০ ভাগ বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে (সামষ্টিক মূল্যায়ন) মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে যথাক্রমে ৬০ ভাগ ও ৪০ ভাগ গাঠনিক মূল্যায়ন ও সামষ্টিক মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। দশম শ্রেণিতে উভয় ধরনের মূল্যায়ন সমান অর্থাৎ ৫০ ভাগ করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গাঠনিক মূল্যায়ন ৩০ ভাগ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ ভাগের কথা বলা হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে গাঠনিক মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিলেও উপরের শ্রেণিগুলোতে পর্যায়ক্রমে সামষ্টিক মূল্যায়নের পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীর জ্ঞান যাচাইয়ের জন্য সামষ্টিক মূল্যায়ন উত্তম ব্যবস্থা। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষক সমাজ মনে করে নতুন শিক্ষাক্রম সংশোধনের প্রয়োজন।

বর্তমানে বেসরকারি কলেজগুলোয় সরকার থেকে ‘সহকারী অধ্যাপক’ পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা রয়েছে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ‘অধ্যাপক’ পদ পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ সরকার সহকারী অধ্যাপকের বেতন বহন করে আর সেসব কলেজ শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ বেতন বহন করতে সক্ষম তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতন স্বপদে প্রদান করতে পারে। অন্যরা যথাযথ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়। শিক্ষকসমাজ আজকের এই দিনটিতে প্রত্যাশা করে সরকার থেকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে পদোন্নতির ঘোষণা আসবে।

প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকসমাজ কিছু প্রত্যাশা করে ক্ষমতাসীনদের কাছে। বাংলাদেশে এ দিবসে শিক্ষকদের প্রত্যাশা হলো চাকরি জাতীয়করণ। চাকরি জাতীয়করণ করলে শিক্ষকদের অধিকার আদায় হবে, শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা পাবে, শিক্ষকরা কর্তব্যপরায়ণ হবে। তাতে করে ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ বেশ বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মোকাবিলা করে যাচ্ছে। তাই জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য নিম্নের কিছু প্রস্তাব বিবেচনার দাবি রাখে। প্রস্তাবগুলো হলো-

১. স্নাতক (পাশ/অনার্স) থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের বেতন কোড ০৪ এবং উপাধ্যক্ষের বেতন কোড-০৫, সেসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের বেতন কোড-০৩ এবং উপাধ্যক্ষের বেতন কোড-০৪ এ উন্নিত করতে হবে।

২. থানা ভিত্তিক এ ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট শিক্ষকের একটা নির্দিষ্ট হারে একই পর্যায়ের শিক্ষকতায় মোট ২২ বছর ও ২০ বছরের প্রকৃত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের অধ্যাপক বেতন কোড-০৪ এবং সহযোগী অধ্যাপক বেতন কোড-০৫ প্রদান করতে হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রম চলছে সেখানে শিক্ষকদের শ্রেণি বক্তৃতা পর্যবেক্ষণ করে (কতক্ষণ বক্তৃতা প্রদানে সক্ষম, বক্তৃতার মান, বক্তৃতা প্রদানের কৃত্রিমতা পরিহার করা, স্বাভাবিক থাকা প্রভৃতি যাচাই করে) প্রকৃত অভিজ্ঞ শিক্ষক বাছাই করা যাবে। আর যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা নেই সেখানে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে তা করতে হবে। এ প্রবন্ধে থানা ভিত্তিক ১০ শতাংশ শিক্ষককে অধ্যাপক ও ১০ শতাংশ শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির প্রস্তাব করা হলো; যা এমপিওভুক্ত স্নাতক (পাশ), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কলেজে সীমাবদ্ধ থাকবে।

৩. প্রতিষ্ঠান প্রধান হওয়ার জন্য সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার ২০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং ৫০ বছর বয়স হওয়ার বিধান চালু করতে হবে।

৪. বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে।

৫. সর্বশেষ বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া প্রদান করতে হবে।

৬. সর্বশেষ বেতন স্কেলের ২০ শতাংশ চিকিৎসা ভাতা প্রদান করতে হবে।

৭. মহানগরের জীবন-যাপন ব্যয় অধিক বলে মহানগর শিক্ষকদের সর্বশেষ বেতন স্কেলের একটা নির্দিষ্ট হারে মহানগর ভাতা প্রদান করতে হবে।

৮. বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরির নির্ধারিত প্রবেশ বয়স বাতিল করে অবসর বয়স গড় আয়ুর সমান অর্থাৎ ৭২ (বাহাত্তর) বছর করতে হবে। সব স্তরের শিক্ষক তথা শিক্ষা শ্রমিক এবং সব প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার (যারা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসাবে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন) ক্ষেত্রে গড় আয়ুর সমান অবসর বয়স নির্ধারণের বিষয়টি বিবেচনার দাবি রইল।

৯. কলেজ তথা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকদের চাকরিতে প্রবেশ বেতন কোড-৮ নির্ধারণ করতে হবে।

১০. মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নির্ধারিত অভিজ্ঞতা থাকা সাপেক্ষে ব্যাচেলর অব এডুকেশন সার্টিফিকেট জমা প্রদান করলে তাকে উচ্চতর স্কেল প্রদান করতে হবে।

আমরা প্রত্যাশা করি, ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ আমাদের দেশ বাস্তবায়িত হবে। সে হিসাবে সরকার উল্লেখিত বর্ণনা অনুসারে শিক্ষক ও শিক্ষার অগ্রগতিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

কাজী মুহাম্মদ মাইন উদ্দীন

প্রবন্ধকার ও শিক্ষা বিশ্লেষক

মানসম্মত শিক্ষাক্রম ও শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করুন

শিক্ষক দিবস হলো শিক্ষকদের সম্মানে পালিত একটি বিশেষ দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন দিনে শিক্ষক দিবস পালন করে থাকে। তবে ১০০টিরও বেশি দেশ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করে। বিশ্ব শিক্ষক সংঘ তথা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় এবং ইউনেস্কো-আইএলও’র সদিচ্ছায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলনে শিক্ষকের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদাবিষয়ক সনদ ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ প্রণীত হয়। সেজন্য ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক ফ্রেডারিক এম মেয়র এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের অনুরোধে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন। এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল গঠিত হয় ১৯৯৩ সালে। এটি বেলজিয়ামভিত্তিক একটি শিক্ষা সংক্রান্ত সংস্থা।

এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো-The Transformation of education begins with teachers. অর্থাৎ, শিক্ষার রূপান্তর শুরু হয় শিক্ষকদের দিয়ে। অন্য কথায়, শিক্ষকদের দিয়ে শিক্ষার পরিবর্তন শুরু হয়। এ প্রতিপাদ্যটি শতভাগ যথার্থ। কিন্তু শিক্ষার পরিবর্তন শিক্ষকদের দিয়ে শুরু করতে হলে তাদের মান উন্নত করতে হবে। শিক্ষকের মানের উন্নতির জন্য প্রয়োজন উন্নত নিয়োগ প্রক্রিয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান, শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রভৃতি। ২০০৫ সাল থেকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৮ সাল থেকে এর আরও উন্নত সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ চলছে। ফলে বেসরকারি সেক্টর মানসম্মত শিক্ষক পেতে শুরু করছে। তাছাড়া পূর্ব থেকে শিক্ষকের মান উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে বেসরকারি শিক্ষা সেক্টর পর্যায়ক্রমে মানসম্মত হচ্ছে। কিন্তু এখন প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষাক্রম, শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করা।

আগামী বছর থেকে শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রমটি ‘শিক্ষাক্রম ২০২২’ নামে পরিচিত। কোভিড-১৯ এর কারণে যথাসময়ে শিক্ষাক্রম চালু করা যায়নি। নতুন শিক্ষাক্রমে গাঠনিক মূল্যায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে গাঠনিক মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের ২০ ভাগ জ্ঞান দান করতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে-যে ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থী কতটুকু জানতে পারল তা যাচাই করা যায়, তা হলো মূল্যায়ন। মূল্যায়ন হলো, শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন যাচাইয়ের পরিমাপক। আমাদের দেশে দুটি পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন পরিমাপ করা হয়। একটি হলো গাঠনিক মূল্যায়ন; অন্যটি সামষ্টিক মূল্যায়ন। শ্রেণি কার্যক্রম চলাকালীন শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি ও আচরণের বিভিন্নমুখী বিকাশ সম্পর্কে জানার জন্য বিষয় শিক্ষক কর্তৃক যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তা হলো গাঠনিক মূল্যায়ন। অন্য দিকে শিক্ষাবর্ষের কোনো নির্ধারিত পাঠ সমাপ্ত করে/পাঠ বন্ধ রেখে শিক্ষার্থী তার পঠিত বিষয়গুলোয় কীরূপ জ্ঞান অর্জন করেছে, তা যাচাইয়ের জন্য যে ব্যবস্থা করা হয়, তা হলো সামষ্টিক মূল্যায়ন। মূল্যায়নের জগতে সামষ্টিক মূল্যায়ন হলো শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন।

শিক্ষাক্রম ২০২২-এ বিভিন্ন শ্রেণিতে গাঠনিক মূল্যায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে প্রাকপ্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক (গাঠনিক) মূল্যায়নের নির্দেশনা রয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৭০ ভাগ শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক (গাঠনিক) মূল্যায়ন ও ৩০ ভাগ বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে (সামষ্টিক মূল্যায়ন) মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে যথাক্রমে ৬০ ভাগ ও ৪০ ভাগ গাঠনিক মূল্যায়ন ও সামষ্টিক মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। দশম শ্রেণিতে উভয় ধরনের মূল্যায়ন সমান অর্থাৎ ৫০ ভাগ করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গাঠনিক মূল্যায়ন ৩০ ভাগ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ ভাগের কথা বলা হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে গাঠনিক মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিলেও উপরের শ্রেণিগুলোতে পর্যায়ক্রমে সামষ্টিক মূল্যায়নের পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীর জ্ঞান যাচাইয়ের জন্য সামষ্টিক মূল্যায়ন উত্তম ব্যবস্থা। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষক সমাজ মনে করে নতুন শিক্ষাক্রম সংশোধনের প্রয়োজন।

বর্তমানে বেসরকারি কলেজগুলোয় সরকার থেকে ‘সহকারী অধ্যাপক’ পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা রয়েছে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ‘অধ্যাপক’ পদ পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ সরকার সহকারী অধ্যাপকের বেতন বহন করে আর সেসব কলেজ শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ বেতন বহন করতে সক্ষম তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতন স্বপদে প্রদান করতে পারে। অন্যরা যথাযথ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়। শিক্ষকসমাজ আজকের এই দিনটিতে প্রত্যাশা করে সরকার থেকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে পদোন্নতির ঘোষণা আসবে।

প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকসমাজ কিছু প্রত্যাশা করে ক্ষমতাসীনদের কাছে। বাংলাদেশে এ দিবসে শিক্ষকদের প্রত্যাশা হলো চাকরি জাতীয়করণ। চাকরি জাতীয়করণ করলে শিক্ষকদের অধিকার আদায় হবে, শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা পাবে, শিক্ষকরা কর্তব্যপরায়ণ হবে। তাতে করে ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ বেশ বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মোকাবিলা করে যাচ্ছে। তাই জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য নিম্নের কিছু প্রস্তাব বিবেচনার দাবি রাখে। প্রস্তাবগুলো হলো-

১. স্নাতক (পাশ/অনার্স) থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের বেতন কোড ০৪ এবং উপাধ্যক্ষের বেতন কোড-০৫, সেসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের বেতন কোড-০৩ এবং উপাধ্যক্ষের বেতন কোড-০৪ এ উন্নিত করতে হবে।

২. থানা ভিত্তিক এ ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট শিক্ষকের একটা নির্দিষ্ট হারে একই পর্যায়ের শিক্ষকতায় মোট ২২ বছর ও ২০ বছরের প্রকৃত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের অধ্যাপক বেতন কোড-০৪ এবং সহযোগী অধ্যাপক বেতন কোড-০৫ প্রদান করতে হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রম চলছে সেখানে শিক্ষকদের শ্রেণি বক্তৃতা পর্যবেক্ষণ করে (কতক্ষণ বক্তৃতা প্রদানে সক্ষম, বক্তৃতার মান, বক্তৃতা প্রদানের কৃত্রিমতা পরিহার করা, স্বাভাবিক থাকা প্রভৃতি যাচাই করে) প্রকৃত অভিজ্ঞ শিক্ষক বাছাই করা যাবে। আর যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা নেই সেখানে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে তা করতে হবে। এ প্রবন্ধে থানা ভিত্তিক ১০ শতাংশ শিক্ষককে অধ্যাপক ও ১০ শতাংশ শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির প্রস্তাব করা হলো; যা এমপিওভুক্ত স্নাতক (পাশ), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কলেজে সীমাবদ্ধ থাকবে।

৩. প্রতিষ্ঠান প্রধান হওয়ার জন্য সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার ২০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং ৫০ বছর বয়স হওয়ার বিধান চালু করতে হবে।

৪. বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে।

৫. সর্বশেষ বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া প্রদান করতে হবে।

৬. সর্বশেষ বেতন স্কেলের ২০ শতাংশ চিকিৎসা ভাতা প্রদান করতে হবে।

৭. মহানগরের জীবন-যাপন ব্যয় অধিক বলে মহানগর শিক্ষকদের সর্বশেষ বেতন স্কেলের একটা নির্দিষ্ট হারে মহানগর ভাতা প্রদান করতে হবে।

৮. বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরির নির্ধারিত প্রবেশ বয়স বাতিল করে অবসর বয়স গড় আয়ুর সমান অর্থাৎ ৭২ (বাহাত্তর) বছর করতে হবে। সব স্তরের শিক্ষক তথা শিক্ষা শ্রমিক এবং সব প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার (যারা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসাবে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন) ক্ষেত্রে গড় আয়ুর সমান অবসর বয়স নির্ধারণের বিষয়টি বিবেচনার দাবি রইল।

৯. কলেজ তথা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকদের চাকরিতে প্রবেশ বেতন কোড-৮ নির্ধারণ করতে হবে।

১০. মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নির্ধারিত অভিজ্ঞতা থাকা সাপেক্ষে ব্যাচেলর অব এডুকেশন সার্টিফিকেট জমা প্রদান করলে তাকে উচ্চতর স্কেল প্রদান করতে হবে।

আমরা প্রত্যাশা করি, ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ আমাদের দেশ বাস্তবায়িত হবে। সে হিসাবে সরকার উল্লেখিত বর্ণনা অনুসারে শিক্ষক ও শিক্ষার অগ্রগতিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

কাজী মুহাম্মদ মাইন উদ্দীন

প্রবন্ধকার ও শিক্ষা বিশ্লেষক