প্রাথমিক শিক্ষা

মেয়াদ না কমিয়ে ডিপিএডের কার্যকারিতা বাড়ান

সালমা আখতার

মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে অনেক মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে; এখনও শিক্ষককে সবচেয়ে ভালো ‘টুল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমেরিকায় শিক্ষক না বলে ‘এডুকেটর’ বলা হচ্ছে।
এখানে আমি আলোকপাত করব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘ডিপিএড’-ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন নিয়ে। কারণ ডিপিএড প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে অকেজো করার যে পরিকল্পনা চলছে; সুদূর আমেরিকায় বসেও তার খবর সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের গুণগত মান বাড়ানোর লক্ষ্যেই এর আগে চালু থাকা সিইনএড বা সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন বাতিল করে শিক্ষানীতি ২০১০- এর সুপারিশের আলোকে দীর্ঘমেয়াদি উদ্ভাবনমূলক আন্তর্জাতিক মানের গতিধারার সঙ্গে মিল রেখে ১৮ মাস মেয়াদি ডিপিএড কার্যক্রম চালু করা হয়েছিল। বর্তমানে তা দেশের সবক’টি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-পিটিআইতে চালু রয়েছে।
বিভিন্ন সময় ডিপিএড কার্যক্রমের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন হয়েছে। তবে ২০২০ সালের অক্টোবরে আমি সমগ্র কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) ইফেকটিভনেস ইভ্যালুয়েশন। বলা যায়, ডিপিএডের কার্যকারিতা মূল্যায়ন। ১২২ পৃষ্ঠার মূল রিপোর্টে আমি গবেষণার উদ্দেশ্যগুলো সামনে রেখে গবেষণা পদ্ধতি নির্ণয় করেছি। ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষ পর্যবেক্ষণ, পিটিআই পরিদর্শন, পিটিআই রিসোর্চ ম্যাপিং, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণার্থীদের ইন্টারভিউ ও আলাপ-আলোচনা, উন্মুক্ত দলীয় আলোচনা, তুলনামূলক সাহিত্য পর্যালোচনা, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে পরামর্শ, দাতা সংস্থ র সঙ্গে পরামর্শ ইত্যাদির সমন্বয়ে আমার গবেষণাকর্মটি যথার্থ বলে আমার বিশ্বাস। নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, কভিড অতিমারির প্রকোপ, অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি নিবিড় অনুসন্ধানমূলক গবেষণা রিপোর্ট তৈরি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে দিয়েছিলাম। মাঠ ও বিভিন্ন পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত এবং অংশীজনের সুপারিশ ও মতামতের ভিত্তিতে যে ফলাফল এসেছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ডিপিএড প্রোগ্রামকে শক্তিশালী, উন্নতকরণ ও আরও উদ্ভাবনমূলক করার জন্য জোরালো সুপারিশ করেছিলাম। ডিপিএডের মেয়াদ না কমিয়ে তা অপরিবর্তিত রাখার (১৮ মাস) ওপর জোর দিয়েছিলাম।
১৮ মাসের প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল নিয়েও বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনের কোনো আপত্তি ছিল না। কেউ কেউ এমনও ইঙ্গিত দিয়েছেন, দুই বছর মেয়াদি কার্যক্রম হতে পারে। পরবর্তী সময়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাস্তবায়নকালে নীতিনির্ধারকরা একে এক বছর মেয়াদি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, এখন এ প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমিয়ে চার থেকে ছয় মাস করার চিন্তাভাবনা চলছে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।
আমার প্রশ্ন হলো, কেন আমরা প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমাতে ইচ্ছুক বা চিন্তাভাবনা করছি? এর পেছনে কি যৌক্তিক কারণ রয়েছে? বাংলাদেশে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে পেশাগত ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক নয়। সাধারণ শিক্ষার নির্দিষ্ট যোগ্যতা/ডিগ্রি নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়। পরীক্ষায় পাসের পর চাকরি হলে তারপর পেশাগত প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। যাঁরা নতুন চাকরিপ্রাপ্ত তাঁদের শিখন-শেখানো কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকে না। তবে তাঁরা প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত গুণগত মানের শিক্ষাদানে সক্ষম হবেন না। যার ফলে দেশে এখনও প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত সসম্প্রসারণ (শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বিদ্যালয় সংখ্যা, অবকাঠামো ইত্যাদি) হলেও তার দ্বারা শ্রেণিকক্ষের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের গুণগত মান প্রতিফলিত হয় না। শিক্ষার্থীদের শিখন ফলাফল/অর্জন স্থায়ী হয় না। একমাত্র এ জন্যই শিক্ষক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য ও অত্যাবশ্যক।
শিখন-শেখানোর নানা তত্ত্ব রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে শিখন-শেখানোর নতুন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ সবকিছুর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশু-মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান, ধারণা, চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা ও মূল্যবোধ। সর্বোপরি দক্ষতা অর্জনে শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং ও মেনটরিং প্রয়োজন।
প্রযুক্তির কল্যাণে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে নানা পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে শিক্ষাকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ ও একীভূত করার প্রচেষ্টা চলছে। একীভূত ও মিশ্র শিখন প্রক্রিয়া এখন যুগের চাহিদায় পরিণত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর গুণগত মানের শিক্ষক তৈরি করতে হলে আলোচিত ৪-৬ মাসের প্রশিক্ষণের মেয়াদ একেবারে অপর্যাপ্ত ও অর্থহীন। পৃথিবীর কোথাও আমার জানামতে চার থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধি করার নজির নেই। চার থেকে ছয় মাস প্রশিক্ষণ কার্যকর হতে পারত, যদি না আমাদের দেশে স্কুল পর্যায় থেকে ‘শিক্ষা’ বা ‘শিক্ষকতা’ বিষয় হিসেবে সিলেবাস থাকত এবং পড়ানো হতো! যে যুক্তির ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমানোর চিন্তাভাবনা চলছে, তা আমার মনে হয়েছে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।
শিক্ষকতা আমার ব্রত। ভালো শিক্ষক হবো ও ভালো শিক্ষক তৈরিতে সহায়তা করব- এ দর্শন সামনে রেখে অর্থনীতিতে লেখাপড়া শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরে এমএড প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছিলাম। শিক্ষা শেষে এখানেই চাকরিরত। শিক্ষকতা, গবেষণা, প্রশাসন সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভালো শিক্ষাদান ছিল আমার অন্তর্নিহিত দর্শন, যা একজন শিক্ষক উচ্চমানের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও ধারাবাহিক আত্মোন্নয়নের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। তাই বলতে চাই, ডিপিএড প্রশিক্ষণের মেয়াদ না কমিয়ে একে কী করে আরও কার্যকরী ও ফলপ্রসূ করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার।
এ উদ্দেশ্যে জাতীয় ভিত্তিতে কর্মশালার আয়োজন করে সংশ্নিষ্ট সবার (শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পিটিআই প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী, নেপ, আইইআর, ঢাবি ও অন্যান্য শিক্ষা সংক্রান্ত এজেন্সি) পরামর্শ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা হোক। নতুন শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক মূল্যায়ন পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে ডিপিএড কার্যক্রমকে পুনর্বিন্যাস করা হোক। এ ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমান চিন্তাভাবনা আমার মতো অনেককেই আরও হতাশ করে তুলবে। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন এবং স্বাধীনতার পরপরই যিনি প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা অধরাই রয়ে যাবে; যদিও স্বাধীনতার ৫০ বছর কাটিয়ে এসেছি আমরা।
অধ্যাপক সালমা আখতার :প্রাক্তন পরিচালক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাথমিক শিক্ষা

মেয়াদ না কমিয়ে ডিপিএডের কার্যকারিতা বাড়ান

সালমা আখতার

মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে অনেক মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে; এখনও শিক্ষককে সবচেয়ে ভালো ‘টুল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমেরিকায় শিক্ষক না বলে ‘এডুকেটর’ বলা হচ্ছে।
এখানে আমি আলোকপাত করব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘ডিপিএড’-ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন নিয়ে। কারণ ডিপিএড প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে অকেজো করার যে পরিকল্পনা চলছে; সুদূর আমেরিকায় বসেও তার খবর সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের গুণগত মান বাড়ানোর লক্ষ্যেই এর আগে চালু থাকা সিইনএড বা সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন বাতিল করে শিক্ষানীতি ২০১০- এর সুপারিশের আলোকে দীর্ঘমেয়াদি উদ্ভাবনমূলক আন্তর্জাতিক মানের গতিধারার সঙ্গে মিল রেখে ১৮ মাস মেয়াদি ডিপিএড কার্যক্রম চালু করা হয়েছিল। বর্তমানে তা দেশের সবক’টি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-পিটিআইতে চালু রয়েছে।
বিভিন্ন সময় ডিপিএড কার্যক্রমের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন হয়েছে। তবে ২০২০ সালের অক্টোবরে আমি সমগ্র কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) ইফেকটিভনেস ইভ্যালুয়েশন। বলা যায়, ডিপিএডের কার্যকারিতা মূল্যায়ন। ১২২ পৃষ্ঠার মূল রিপোর্টে আমি গবেষণার উদ্দেশ্যগুলো সামনে রেখে গবেষণা পদ্ধতি নির্ণয় করেছি। ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষ পর্যবেক্ষণ, পিটিআই পরিদর্শন, পিটিআই রিসোর্চ ম্যাপিং, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণার্থীদের ইন্টারভিউ ও আলাপ-আলোচনা, উন্মুক্ত দলীয় আলোচনা, তুলনামূলক সাহিত্য পর্যালোচনা, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে পরামর্শ, দাতা সংস্থ র সঙ্গে পরামর্শ ইত্যাদির সমন্বয়ে আমার গবেষণাকর্মটি যথার্থ বলে আমার বিশ্বাস। নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, কভিড অতিমারির প্রকোপ, অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি নিবিড় অনুসন্ধানমূলক গবেষণা রিপোর্ট তৈরি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে দিয়েছিলাম। মাঠ ও বিভিন্ন পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত এবং অংশীজনের সুপারিশ ও মতামতের ভিত্তিতে যে ফলাফল এসেছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ডিপিএড প্রোগ্রামকে শক্তিশালী, উন্নতকরণ ও আরও উদ্ভাবনমূলক করার জন্য জোরালো সুপারিশ করেছিলাম। ডিপিএডের মেয়াদ না কমিয়ে তা অপরিবর্তিত রাখার (১৮ মাস) ওপর জোর দিয়েছিলাম।
১৮ মাসের প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল নিয়েও বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনের কোনো আপত্তি ছিল না। কেউ কেউ এমনও ইঙ্গিত দিয়েছেন, দুই বছর মেয়াদি কার্যক্রম হতে পারে। পরবর্তী সময়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাস্তবায়নকালে নীতিনির্ধারকরা একে এক বছর মেয়াদি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, এখন এ প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমিয়ে চার থেকে ছয় মাস করার চিন্তাভাবনা চলছে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।
আমার প্রশ্ন হলো, কেন আমরা প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমাতে ইচ্ছুক বা চিন্তাভাবনা করছি? এর পেছনে কি যৌক্তিক কারণ রয়েছে? বাংলাদেশে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে পেশাগত ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক নয়। সাধারণ শিক্ষার নির্দিষ্ট যোগ্যতা/ডিগ্রি নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়। পরীক্ষায় পাসের পর চাকরি হলে তারপর পেশাগত প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। যাঁরা নতুন চাকরিপ্রাপ্ত তাঁদের শিখন-শেখানো কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকে না। তবে তাঁরা প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত গুণগত মানের শিক্ষাদানে সক্ষম হবেন না। যার ফলে দেশে এখনও প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত সসম্প্রসারণ (শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বিদ্যালয় সংখ্যা, অবকাঠামো ইত্যাদি) হলেও তার দ্বারা শ্রেণিকক্ষের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের গুণগত মান প্রতিফলিত হয় না। শিক্ষার্থীদের শিখন ফলাফল/অর্জন স্থায়ী হয় না। একমাত্র এ জন্যই শিক্ষক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য ও অত্যাবশ্যক।
শিখন-শেখানোর নানা তত্ত্ব রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে শিখন-শেখানোর নতুন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ সবকিছুর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশু-মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান, ধারণা, চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা ও মূল্যবোধ। সর্বোপরি দক্ষতা অর্জনে শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং ও মেনটরিং প্রয়োজন।
প্রযুক্তির কল্যাণে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে নানা পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে শিক্ষাকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ ও একীভূত করার প্রচেষ্টা চলছে। একীভূত ও মিশ্র শিখন প্রক্রিয়া এখন যুগের চাহিদায় পরিণত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর গুণগত মানের শিক্ষক তৈরি করতে হলে আলোচিত ৪-৬ মাসের প্রশিক্ষণের মেয়াদ একেবারে অপর্যাপ্ত ও অর্থহীন। পৃথিবীর কোথাও আমার জানামতে চার থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধি করার নজির নেই। চার থেকে ছয় মাস প্রশিক্ষণ কার্যকর হতে পারত, যদি না আমাদের দেশে স্কুল পর্যায় থেকে ‘শিক্ষা’ বা ‘শিক্ষকতা’ বিষয় হিসেবে সিলেবাস থাকত এবং পড়ানো হতো! যে যুক্তির ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমানোর চিন্তাভাবনা চলছে, তা আমার মনে হয়েছে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।
শিক্ষকতা আমার ব্রত। ভালো শিক্ষক হবো ও ভালো শিক্ষক তৈরিতে সহায়তা করব- এ দর্শন সামনে রেখে অর্থনীতিতে লেখাপড়া শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরে এমএড প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছিলাম। শিক্ষা শেষে এখানেই চাকরিরত। শিক্ষকতা, গবেষণা, প্রশাসন সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভালো শিক্ষাদান ছিল আমার অন্তর্নিহিত দর্শন, যা একজন শিক্ষক উচ্চমানের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও ধারাবাহিক আত্মোন্নয়নের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। তাই বলতে চাই, ডিপিএড প্রশিক্ষণের মেয়াদ না কমিয়ে একে কী করে আরও কার্যকরী ও ফলপ্রসূ করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার।
এ উদ্দেশ্যে জাতীয় ভিত্তিতে কর্মশালার আয়োজন করে সংশ্নিষ্ট সবার (শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পিটিআই প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী, নেপ, আইইআর, ঢাবি ও অন্যান্য শিক্ষা সংক্রান্ত এজেন্সি) পরামর্শ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা হোক। নতুন শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক মূল্যায়ন পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে ডিপিএড কার্যক্রমকে পুনর্বিন্যাস করা হোক। এ ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমান চিন্তাভাবনা আমার মতো অনেককেই আরও হতাশ করে তুলবে। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন এবং স্বাধীনতার পরপরই যিনি প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা অধরাই রয়ে যাবে; যদিও স্বাধীনতার ৫০ বছর কাটিয়ে এসেছি আমরা।
অধ্যাপক সালমা আখতার :প্রাক্তন পরিচালক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়