শিক্ষক দিবস ও শিক্ষা ভাবনা

জহুরুল হক বুলবুল
শিক্ষকদের হাত ধরেই শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর শুরু।’ এই প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। একই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশে শিক্ষক দিবস ২০২২ উদ্যাপন করা হচ্ছে। শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানাতে, তাদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর দিবসটি উদ্যাপনে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় পর্যায়ে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের পাশাপাশি বিভাগীয় শহর এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষকসংগঠনগুলোও দিবসটি যথাযথ পালন করছে।মানুষের মধ্যে যেসব গুণ রয়েছে—শিক্ষা সেগুলোকে বিকশিত করে। শিক্ষা মানবজীবনকে পরিশীলিত করে। তাই শিক্ষা জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির ধারক ও বাহক। এজন্য শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শিক্ষা কথাটি এলেই প্রথমে যে কথাটি আসে তা হলো শিক্ষক। শিক্ষক হলো শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। কেননা, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উত্কর্ষ নির্ভর করে শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা, নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার ওপর। মেধাবী ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকগণই মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।
এই শিক্ষক দিবসে দাঁড়িয়ে যদি জিগ্যেস করি কেমন আছেন আমাদের শিক্ষক সমাজ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে শিক্ষক সমাজ এখনো অর্থনৈতিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। শিক্ষকদের অবস্থা আজও অত্যন্ত নাজুক, সামাজিকভাবে তো বটেই, পেশাগতভাবেও। বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) শিক্ষকগণ আরো অবহেলিত। এ দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে ২৬ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারীর অবস্থা আরো নাজুক। অনেক প্রতিষ্ঠানেই নেই লাইব্রেরি, নেই গবেষণাগার ও খেলার মাঠ। যেসব প্রতিষ্ঠানে আছে তাও মানসম্মত নয়। নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষা উপকরণ ও আসবাবপত্র। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়নি এমপিওভুক্ত। আবার অনেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানেরও সব শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন। এদের অবস্থা আরো করুণ। যেসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন তাদের অধিকাংশ চাকরির শুরু থেকেও এমপিওভুক্ত হননি। অথচ এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির অভিজ্ঞতা হিসেব করা হয়। বছরের পর বছর বেতন না পাওয়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এমনকি এমপিওভুক্ত হওয়ার আগেই অবসরে যান অনেক শিক্ষক।

সব পেশাতেই সুযোগ-সুবিধা দিন দিন বাড়ে। বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টা অত্যন্ত জটিল ও অমানবিক। আগে সৌভাগ্যবান কলেজ শিক্ষকগণ পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হতেন। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়ে হবেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। পদোন্নতির জটিল নিয়মে—অনেক শিক্ষককেই প্রভাষক পদ থেকেই অবসর নিতে হয়। দরকার সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আরো সহজ করে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা। বাড়িভাড়া প্রতিষ্ঠান প্রধান (অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সুপার) থেকে প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সবার মাত্র ১ হাজার টাকা, যা হাস্যকর ও লজ্জাকর।সরকারি চাকরিজীবীরা অবসর জীবনেও উত্সব বোনাস পান। অন্যদিকে চাকরিতে থাকাকালীনই কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ মূল বেতন স্কেলের ২৫ শতাংশ বোনাস পান—যা দেখে মনে হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পরিবারের উত্সব-পার্বণ থাকতে নেই। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা পূর্ণাঙ্গ চিকিত্সা ভাতা থেকেও বঞ্চিত, যা মাত্র ৫০০ টাকা। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বর্তমান যুগে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দুর্ঘটনাজনিত কারণে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। অথচ শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। এমপিওভুক্ত স্বল্প বেতনের শিক্ষকরা শিক্ষকতাজীবন থেকে অবসরের পর জীবনসায়াহ্নে অবসর সুবিধার অর্থের দুশ্চিন্তায় দিন পার করেন। অবসরে যাবার কতদিন পর যে, অবসর সুবিধার টাকা পাওয়া যাবে শিক্ষক যেমন জানেন না, তেমনি জানে না অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানও। অনেক শিক্ষকের ভাগ্যেই জীবদ্দশায় এ অর্থ প্রাপ্তি জোটে না। এর চেয়ে লজ্জা, অপমান, কষ্ট আর কী হতে পারে। অথচ অবসর সুবিধা বোর্ডের জন্য শিক্ষকগণ প্রতি মাসে মূল বেতনের ১০ শতাংশ চাঁদা দিয়ে থাকেন। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য এখনো অনেকাংশে দূর করা তো হয়নি বরং বাড়ছে—এসব বৈষম্য দূূর করা বর্তমান সময়ের অপরিহার্য দাবি। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্রও ভালো নয়। অথচ শিক্ষার বুনিয়াদ গড়ে তুলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন নিয়োগ হলেও অনেক বিদ্যালয়ে এখনো নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি। তাই সেসব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ক্লাসবেল বাড়ি দেওয়া থেকে শুরু করে পিয়ন, কেরানির যাবতীয় কাজ করে ক্লাস নিতে হয়। সব মিলে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, শিক্ষক কোনোটার অবস্থাই ভালো নয়। যে কোনো অফিসের কর্মচারীর যে বাজার করার সামর্থ্য—একজন শিক্ষকের সে সামর্থ্য নেই, যদি না তার অন্য কোনো আয়ের উত্স থাকে।

শিক্ষকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের কথাটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। হয়েছে শ্রেণিকক্ষ থেকে রাজপথে আন্দোলন। শিক্ষকদের কথা বললেই সরকার থেকে শুরু করে অনেকেই দেশের দারিদ্র্যের কথা তোলেন, যেন শিক্ষার জন্য যথোপযুক্ত অর্থ সংস্থান ছাড়াই শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে। শিক্ষাবিদগণ মনে করেন, আমাদের এই দেশে অর্থের যে অপচয় হয় তা দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রের সব সমস্যা দূর করেও বাঁচবে অর্থ। যেহেতু দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাই বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর জাতির কৃষ্টি, সভ্যতা ও সমৃদ্ধি অনেকটা নির্ভর করে। বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না করে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব না। শিক্ষক সংগঠনগুলোর দাবি, এ সমস্যা সমাধানে চাকরি জাতীয়করণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে—শিক্ষকদের অতীত যাবতীয় অসংগতি বিবেচনায় এনে শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে হবে। তা না হলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা আকৃষ্ট হবেন না। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল দেওয়া উচিত। এটা শিক্ষার জন্য দেশ জাতির জন্য, ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য করা উচিত।

আজকের শিক্ষকরা আগামীর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সব সমস্যার যৌক্তিক সমাধান করে শিক্ষা থেকে অন্তরায়ের সব জগদ্দল পাথর সরাতে হবে। করতে হবে এ পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট। শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তোলার জন্য তুলে দিতে হবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের হাতে। আজ শিক্ষক দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ভবিষ্যত্ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে স্বপ্নবাজ হয়ে গড়ে উঠুক শিক্ষার্থীরা। আলোকিত জাতি গঠনের মাধ্যমে আমাদের দেশ পৃথিবীর বুকে দাঁড়াক মাথা উঁচু করে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

শিক্ষক দিবস ও শিক্ষা ভাবনা

জহুরুল হক বুলবুল
শিক্ষকদের হাত ধরেই শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর শুরু।’ এই প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। একই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশে শিক্ষক দিবস ২০২২ উদ্যাপন করা হচ্ছে। শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানাতে, তাদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর দিবসটি উদ্যাপনে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় পর্যায়ে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের পাশাপাশি বিভাগীয় শহর এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষকসংগঠনগুলোও দিবসটি যথাযথ পালন করছে।মানুষের মধ্যে যেসব গুণ রয়েছে—শিক্ষা সেগুলোকে বিকশিত করে। শিক্ষা মানবজীবনকে পরিশীলিত করে। তাই শিক্ষা জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির ধারক ও বাহক। এজন্য শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শিক্ষা কথাটি এলেই প্রথমে যে কথাটি আসে তা হলো শিক্ষক। শিক্ষক হলো শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। কেননা, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উত্কর্ষ নির্ভর করে শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা, নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার ওপর। মেধাবী ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকগণই মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।
এই শিক্ষক দিবসে দাঁড়িয়ে যদি জিগ্যেস করি কেমন আছেন আমাদের শিক্ষক সমাজ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে শিক্ষক সমাজ এখনো অর্থনৈতিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। শিক্ষকদের অবস্থা আজও অত্যন্ত নাজুক, সামাজিকভাবে তো বটেই, পেশাগতভাবেও। বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) শিক্ষকগণ আরো অবহেলিত। এ দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে ২৬ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারীর অবস্থা আরো নাজুক। অনেক প্রতিষ্ঠানেই নেই লাইব্রেরি, নেই গবেষণাগার ও খেলার মাঠ। যেসব প্রতিষ্ঠানে আছে তাও মানসম্মত নয়। নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষা উপকরণ ও আসবাবপত্র। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়নি এমপিওভুক্ত। আবার অনেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানেরও সব শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন। এদের অবস্থা আরো করুণ। যেসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন তাদের অধিকাংশ চাকরির শুরু থেকেও এমপিওভুক্ত হননি। অথচ এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির অভিজ্ঞতা হিসেব করা হয়। বছরের পর বছর বেতন না পাওয়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এমনকি এমপিওভুক্ত হওয়ার আগেই অবসরে যান অনেক শিক্ষক।

সব পেশাতেই সুযোগ-সুবিধা দিন দিন বাড়ে। বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টা অত্যন্ত জটিল ও অমানবিক। আগে সৌভাগ্যবান কলেজ শিক্ষকগণ পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হতেন। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়ে হবেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। পদোন্নতির জটিল নিয়মে—অনেক শিক্ষককেই প্রভাষক পদ থেকেই অবসর নিতে হয়। দরকার সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আরো সহজ করে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা। বাড়িভাড়া প্রতিষ্ঠান প্রধান (অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সুপার) থেকে প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সবার মাত্র ১ হাজার টাকা, যা হাস্যকর ও লজ্জাকর।সরকারি চাকরিজীবীরা অবসর জীবনেও উত্সব বোনাস পান। অন্যদিকে চাকরিতে থাকাকালীনই কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ মূল বেতন স্কেলের ২৫ শতাংশ বোনাস পান—যা দেখে মনে হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পরিবারের উত্সব-পার্বণ থাকতে নেই। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা পূর্ণাঙ্গ চিকিত্সা ভাতা থেকেও বঞ্চিত, যা মাত্র ৫০০ টাকা। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বর্তমান যুগে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দুর্ঘটনাজনিত কারণে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। অথচ শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। এমপিওভুক্ত স্বল্প বেতনের শিক্ষকরা শিক্ষকতাজীবন থেকে অবসরের পর জীবনসায়াহ্নে অবসর সুবিধার অর্থের দুশ্চিন্তায় দিন পার করেন। অবসরে যাবার কতদিন পর যে, অবসর সুবিধার টাকা পাওয়া যাবে শিক্ষক যেমন জানেন না, তেমনি জানে না অর্থ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানও। অনেক শিক্ষকের ভাগ্যেই জীবদ্দশায় এ অর্থ প্রাপ্তি জোটে না। এর চেয়ে লজ্জা, অপমান, কষ্ট আর কী হতে পারে। অথচ অবসর সুবিধা বোর্ডের জন্য শিক্ষকগণ প্রতি মাসে মূল বেতনের ১০ শতাংশ চাঁদা দিয়ে থাকেন। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য এখনো অনেকাংশে দূর করা তো হয়নি বরং বাড়ছে—এসব বৈষম্য দূূর করা বর্তমান সময়ের অপরিহার্য দাবি। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্রও ভালো নয়। অথচ শিক্ষার বুনিয়াদ গড়ে তুলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন নিয়োগ হলেও অনেক বিদ্যালয়ে এখনো নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি। তাই সেসব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ক্লাসবেল বাড়ি দেওয়া থেকে শুরু করে পিয়ন, কেরানির যাবতীয় কাজ করে ক্লাস নিতে হয়। সব মিলে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, শিক্ষক কোনোটার অবস্থাই ভালো নয়। যে কোনো অফিসের কর্মচারীর যে বাজার করার সামর্থ্য—একজন শিক্ষকের সে সামর্থ্য নেই, যদি না তার অন্য কোনো আয়ের উত্স থাকে।

শিক্ষকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের কথাটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। হয়েছে শ্রেণিকক্ষ থেকে রাজপথে আন্দোলন। শিক্ষকদের কথা বললেই সরকার থেকে শুরু করে অনেকেই দেশের দারিদ্র্যের কথা তোলেন, যেন শিক্ষার জন্য যথোপযুক্ত অর্থ সংস্থান ছাড়াই শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে। শিক্ষাবিদগণ মনে করেন, আমাদের এই দেশে অর্থের যে অপচয় হয় তা দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রের সব সমস্যা দূর করেও বাঁচবে অর্থ। যেহেতু দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাই বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর জাতির কৃষ্টি, সভ্যতা ও সমৃদ্ধি অনেকটা নির্ভর করে। বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না করে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব না। শিক্ষক সংগঠনগুলোর দাবি, এ সমস্যা সমাধানে চাকরি জাতীয়করণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে—শিক্ষকদের অতীত যাবতীয় অসংগতি বিবেচনায় এনে শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে হবে। তা না হলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা আকৃষ্ট হবেন না। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল দেওয়া উচিত। এটা শিক্ষার জন্য দেশ জাতির জন্য, ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য করা উচিত।

আজকের শিক্ষকরা আগামীর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সব সমস্যার যৌক্তিক সমাধান করে শিক্ষা থেকে অন্তরায়ের সব জগদ্দল পাথর সরাতে হবে। করতে হবে এ পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট। শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তোলার জন্য তুলে দিতে হবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের হাতে। আজ শিক্ষক দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ভবিষ্যত্ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে স্বপ্নবাজ হয়ে গড়ে উঠুক শিক্ষার্থীরা। আলোকিত জাতি গঠনের মাধ্যমে আমাদের দেশ পৃথিবীর বুকে দাঁড়াক মাথা উঁচু করে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি