শিক্ষক-শিক্ষার্থী না গুরু-শিষ্য?

গত ২৭ অক্টোবর আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষক দিবস পালিত হয়। দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিক্ষকদের হাত ধরেই শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর শুরু’। এ উদযাপনে প্রতিপাদ্যের পাশাপাশি ‘সমাজ ও জাতীয় জীবনে শিক্ষকের মর্যাদাগত অবস্থান, নীতি ও বিবেক-বোধসম্পন্ন মানুষ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা’ ইত্যাদি প্রসঙ্গেও কমবেশি আলোকপাত করা হয়েছে। দিবসের আয়োজক ও আলোচক উভয় ক্ষেত্রে কুশীলবের ভূমিকায় ছিলেন শিক্ষক বা শিক্ষাসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। তাই এ আয়োজনে ‘আত্মসমালোচনা’ এড়িয়ে দিল খোলা আত্মপ্রশংসার কথাই বেশি উচ্চারিত হয়েছে। আজকের দিনে যাঁরা ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী’ হিসেবে গণ্য, তাঁদের পৌরাণিক নাম ‘গুরু-শিষ্য’। সে আমলে গুরু ছিলেন উদার দাতা, শিষ্য ছিলেন প্রশ্নহীন গ্রহীতা। বিদ্যাদানকে তখন গণ্য করা হতো ‘মহান ব্রত বা উপাসনা’ হিসেবে। কালান্তরে ‘বিদ্যাদান’ শব্দের ব্যাপক অর্থান্তর ঘটেছে। ‘ব্রত’ থেকে তা পরিণত হয়েছে ‘মহান পেশা’ হিসেবে। পেশার সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তাই ‘আর্থিক বিনিময়যুক্ত’ বিদ্যাদান ক্রমঅবনতিপ্রাপ্ত হতে হতে সাদামাটা ‘চাকরি’ হিসেবে নিষ্প্র্রভতায় আচ্ছাদিত। আগে যাঁরা বিদ্যাপীঠ বানাতেন, তাঁরা ছিলেন নির্মোহ দানবীর বা অকৃত্রিম সমাজসেবক। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল- শিক্ষার প্রসার, দেশ ও জাতির কল্যাণ। এখন বিদ্যাপীঠ বানান বণিক শ্রেণি। তাঁদের উদ্দেশ্য একটাই- মুনাফা অর্জন। তাঁদের পুঁজির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের ধরন ও প্রকৃতি। বড় পুঁজিওয়ালার হাত থেকে জন্ম নেয় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। কম পুঁজিদাররা হাত দেন প্রথাগত স্কুল বা কিন্ডারগার্টেন গড়ার কাজে। অবশ্য কিন্ডারগার্টেন জন্মদাতার পরিচয় সহজ ছকে আঁকার সুযোগ নেই। এ জগতে বড়-মাঝারি-ছোট সব কারবারির অবাধ আনাগোনা। কারণ এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়তে বা চালাতে ব্যয় কম, লাভ বেশি। তা ছাড়া এখানে যাকে তাকে নিয়োগ দেওয়া যায়; ইচ্ছামতো কর্তৃত্ব ফলানো যায়; শ্রমিকের চেয়েও কম মূল্য দিয়ে শিক্ষাশ্রম কেনা যায়। যোগ্যতা যা-ই থাক, নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজেই বা পছন্দের লোককে অধ্যক্ষ বানানো যায়।
বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র, উন্নয়ন বা সদর্থক-যাত্রায় বাঙালির গতি খুব ধীর। কখনও তা স্থবিরপ্রায়, নিশ্চল। কিন্তু অবনমন বা সৃষ্টিহীন ভেজাল কাজে বাঙালিমাত্রই বেজায় দ্রুতগামী পথিক। বাজার অর্থনীতির সর্বগ্রাসী প্রভাবের মধ্যেও উন্নত জাতিগুলো বেশ কয়েকটি মৌলিক বিষয় বিশেষত শিক্ষাকে ‘বাণিজ্য-বলয়’-এর বাইরে রেখেছে। কিন্তু বাঙালি বেসরকারি পর্যায়ে তো বটেই, এমনকি সরকারি পর্যায় থেকেও শিক্ষাকে গ্রহণ করেছে লাভজনক কারবারের খাত হিসেবে।
‘গুরু-শিষ্য’ সম্পর্ক নিয়ে আমাদের পুরাণ ইতিহাসে অনেক ‘সুভাষিত’ গল্পকথা প্রচলিত। এসব গল্পকথার সত্যতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। তবে এসব গল্পের ভেতর অন্তত একটা সত্য আছে। আর তা হলো, নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ, ভাবের আদান-প্রদান, পারস্পরিক মিথস্ট্ক্রিয়া ব্যতীত কোনো সম্পর্কই গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী দু’পক্ষই যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। শিক্ষাপীঠ নামক ‘জনাকীর্ণ’ প্রপঞ্চে তারা পরস্পর ভালো করে চেনেই না। চিনলেও তা এমনই অগভীর, তাতে স্নেহ-প্রাণ-শ্রদ্ধা বা ভক্তির সংযোগ নেই বললেই চলে। ‘শিক্ষাদান’-এর ক্রমবিবর্তনের স্বরূপ লক্ষ্য করে বহু বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, ‘আজকাল প্রয়োজনের নিয়মে শিক্ষকের গরজ ছাত্রের কাছে আসা, কিন্তু স্বভাবের নিয়মে শিষ্যের গরজ গুরুকে লাভ করা। শিক্ষক দোকানদার, বিদ্যাদান তাঁহার ব্যবসায়। তিনি খরিদ্দারের সন্ধানে ফেরেন। ব্যবসাদারের কাছে লোকে বস্তু কিনিতে পারে, কিন্তু তাহার পণ্য তালিকার মধ্যে স্নেহ শ্রদ্ধা নিষ্ঠা প্রভৃতি হৃদয়ের সামগ্রী থাকিবে এমন কেহ প্রত্যাশা করিতে পারে না। এই প্রত্যাশা অনুসারেই শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন ও বিদ্যাবস্তু বিক্রয় করেন- এইখানে ছাত্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ।’ (শিক্ষা সমস্যা, পৃ-৩০৭, রবীন্দ্র রচনাবলি, দ্বাদশ খণ্ড)।
বস্তুত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ‘বাণিজ্যিক সম্পর্ক’-এর বিলোপ ঘটিয়ে সেখানে গভীর আত্মিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা- এটাই হোক আমাদের ভবিষ্যৎ-শিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
বিধান মিত্র: অধ্যাপক, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ

শিক্ষক-শিক্ষার্থী না গুরু-শিষ্য?

গত ২৭ অক্টোবর আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষক দিবস পালিত হয়। দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিক্ষকদের হাত ধরেই শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর শুরু’। এ উদযাপনে প্রতিপাদ্যের পাশাপাশি ‘সমাজ ও জাতীয় জীবনে শিক্ষকের মর্যাদাগত অবস্থান, নীতি ও বিবেক-বোধসম্পন্ন মানুষ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা’ ইত্যাদি প্রসঙ্গেও কমবেশি আলোকপাত করা হয়েছে। দিবসের আয়োজক ও আলোচক উভয় ক্ষেত্রে কুশীলবের ভূমিকায় ছিলেন শিক্ষক বা শিক্ষাসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। তাই এ আয়োজনে ‘আত্মসমালোচনা’ এড়িয়ে দিল খোলা আত্মপ্রশংসার কথাই বেশি উচ্চারিত হয়েছে। আজকের দিনে যাঁরা ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী’ হিসেবে গণ্য, তাঁদের পৌরাণিক নাম ‘গুরু-শিষ্য’। সে আমলে গুরু ছিলেন উদার দাতা, শিষ্য ছিলেন প্রশ্নহীন গ্রহীতা। বিদ্যাদানকে তখন গণ্য করা হতো ‘মহান ব্রত বা উপাসনা’ হিসেবে। কালান্তরে ‘বিদ্যাদান’ শব্দের ব্যাপক অর্থান্তর ঘটেছে। ‘ব্রত’ থেকে তা পরিণত হয়েছে ‘মহান পেশা’ হিসেবে। পেশার সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তাই ‘আর্থিক বিনিময়যুক্ত’ বিদ্যাদান ক্রমঅবনতিপ্রাপ্ত হতে হতে সাদামাটা ‘চাকরি’ হিসেবে নিষ্প্র্রভতায় আচ্ছাদিত। আগে যাঁরা বিদ্যাপীঠ বানাতেন, তাঁরা ছিলেন নির্মোহ দানবীর বা অকৃত্রিম সমাজসেবক। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল- শিক্ষার প্রসার, দেশ ও জাতির কল্যাণ। এখন বিদ্যাপীঠ বানান বণিক শ্রেণি। তাঁদের উদ্দেশ্য একটাই- মুনাফা অর্জন। তাঁদের পুঁজির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের ধরন ও প্রকৃতি। বড় পুঁজিওয়ালার হাত থেকে জন্ম নেয় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। কম পুঁজিদাররা হাত দেন প্রথাগত স্কুল বা কিন্ডারগার্টেন গড়ার কাজে। অবশ্য কিন্ডারগার্টেন জন্মদাতার পরিচয় সহজ ছকে আঁকার সুযোগ নেই। এ জগতে বড়-মাঝারি-ছোট সব কারবারির অবাধ আনাগোনা। কারণ এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়তে বা চালাতে ব্যয় কম, লাভ বেশি। তা ছাড়া এখানে যাকে তাকে নিয়োগ দেওয়া যায়; ইচ্ছামতো কর্তৃত্ব ফলানো যায়; শ্রমিকের চেয়েও কম মূল্য দিয়ে শিক্ষাশ্রম কেনা যায়। যোগ্যতা যা-ই থাক, নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজেই বা পছন্দের লোককে অধ্যক্ষ বানানো যায়।
বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র, উন্নয়ন বা সদর্থক-যাত্রায় বাঙালির গতি খুব ধীর। কখনও তা স্থবিরপ্রায়, নিশ্চল। কিন্তু অবনমন বা সৃষ্টিহীন ভেজাল কাজে বাঙালিমাত্রই বেজায় দ্রুতগামী পথিক। বাজার অর্থনীতির সর্বগ্রাসী প্রভাবের মধ্যেও উন্নত জাতিগুলো বেশ কয়েকটি মৌলিক বিষয় বিশেষত শিক্ষাকে ‘বাণিজ্য-বলয়’-এর বাইরে রেখেছে। কিন্তু বাঙালি বেসরকারি পর্যায়ে তো বটেই, এমনকি সরকারি পর্যায় থেকেও শিক্ষাকে গ্রহণ করেছে লাভজনক কারবারের খাত হিসেবে।
‘গুরু-শিষ্য’ সম্পর্ক নিয়ে আমাদের পুরাণ ইতিহাসে অনেক ‘সুভাষিত’ গল্পকথা প্রচলিত। এসব গল্পকথার সত্যতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। তবে এসব গল্পের ভেতর অন্তত একটা সত্য আছে। আর তা হলো, নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ, ভাবের আদান-প্রদান, পারস্পরিক মিথস্ট্ক্রিয়া ব্যতীত কোনো সম্পর্কই গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী দু’পক্ষই যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। শিক্ষাপীঠ নামক ‘জনাকীর্ণ’ প্রপঞ্চে তারা পরস্পর ভালো করে চেনেই না। চিনলেও তা এমনই অগভীর, তাতে স্নেহ-প্রাণ-শ্রদ্ধা বা ভক্তির সংযোগ নেই বললেই চলে। ‘শিক্ষাদান’-এর ক্রমবিবর্তনের স্বরূপ লক্ষ্য করে বহু বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, ‘আজকাল প্রয়োজনের নিয়মে শিক্ষকের গরজ ছাত্রের কাছে আসা, কিন্তু স্বভাবের নিয়মে শিষ্যের গরজ গুরুকে লাভ করা। শিক্ষক দোকানদার, বিদ্যাদান তাঁহার ব্যবসায়। তিনি খরিদ্দারের সন্ধানে ফেরেন। ব্যবসাদারের কাছে লোকে বস্তু কিনিতে পারে, কিন্তু তাহার পণ্য তালিকার মধ্যে স্নেহ শ্রদ্ধা নিষ্ঠা প্রভৃতি হৃদয়ের সামগ্রী থাকিবে এমন কেহ প্রত্যাশা করিতে পারে না। এই প্রত্যাশা অনুসারেই শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন ও বিদ্যাবস্তু বিক্রয় করেন- এইখানে ছাত্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ।’ (শিক্ষা সমস্যা, পৃ-৩০৭, রবীন্দ্র রচনাবলি, দ্বাদশ খণ্ড)।
বস্তুত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ‘বাণিজ্যিক সম্পর্ক’-এর বিলোপ ঘটিয়ে সেখানে গভীর আত্মিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা- এটাই হোক আমাদের ভবিষ্যৎ-শিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
বিধান মিত্র: অধ্যাপক, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ