শিক্ষাক্রমে বিচিত্র মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

কিছু দিন আগ পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে যত শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়েছে, সেগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের একাডেমিক মেধার বিকাশ ঘটানো।

হাওয়ার্ড গার্ডনার মানুষের যে আট রকম মেধার কথা বলেছেন, তার ভেতর কেবল দুই-তিন ধরনের মেধা বা যাদের এ দুই-তিন ধরনের মেধা আছে তাদের প্রতিই নজর দেওয়া হতো। কিন্তু এখন শিক্ষায় উন্নত দেশগুলো বা তাদের দেখাদেখি যারা শিক্ষায় উন্নত হতে চাচ্ছে, তারা শিক্ষার্থীদের যত ধরনের মেধা আছে তার সব দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করছে। মূলত দুটি কারণে এ কাজটি করতে হচ্ছে। একটি হচ্ছে, ২১ শতকের বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং অপরটি গত শতকের হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের প্রভাব।

হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টকে বিবেচনায় নিলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মেধাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এই ২১ শতকে টিকতে হলে শুধু একাডেমিক নয়, সব শিক্ষার্থীর সব ধরনের মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে। এ মুভমেন্ট ইতোমধ্যেই সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সৌন্দর্য তত্ত্বে এখন ব্যক্তিমানুষের চোখে যা ভালো লাগে তাকেই সুন্দর বলে মনে করা হয়। একইভাবে একটি গণতান্ত্রিক দেশে ভোটার যে দলের পক্ষে রায় দেয়, তারাই দেশ পরিচালনার অধিকার পায়। একজন চিকিৎসকও চিকিৎসা করার সময় রোগীর পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করেন। আর ব্যবসায়ীরা যে ‘কাস্টমার যা চায় তাই সই’ নীতি অবলম্বন করে চলেন, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ব্যবসায় কীভাবে এই হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের প্রভাব পড়েছে তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। হাওয়ার্ড মস্কোউইটজ নামের একজন সাইকোফিজিসিস্ট খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে কাস্টমারদের পছন্দ মাপার কাজ করতেন। একবার তার কাছে পেপসি কোম্পানি আসে তাদের নতুন প্রডাক্ট ‘ডায়েট পেপসি’র মিষ্টির মাত্রা নির্ধারণ করতে। ডায়েট পেপসিতে মিষ্টি স্বাদ যোগ করার জন্য এস্পাটিম বলে একটি রাসায়নিক পদার্থ মেশাতে হয়। এখন কতটুকু এসপাটিম যোগ করলে কাস্টমারদের কাছে মিষ্টির পরিমাণ সঠিক মাত্রার মনে হবে, তা জানতেই হাওয়ার্ডের শরণাপন্ন হওয়া। পেপসির মতো পানীয় কতটুকু মিষ্টি হতে পারে তার একটা সীমা আছে। আট শতাংশের নিচে হলে তা যে মিষ্টি সেটাই বোঝা যাবে না, আর ১২ শতাংশের বেশি হলে তা এত বেশি হবে যে খাওয়াই যাবে না। এখন হাওয়ার্ডকে ৮ ও ১২-এর মধ্যে এমন একটা মাত্রা খুঁজে বের করতে হবে যাতে সবাই তা পান করতে আগ্রহী হয়।

হাওয়ার্ডের মনে হলো কাজটা সোজা। আট থেকে শুরু করে নানা মাত্রার (৮.১, ৮.২, ৮.৩…১২) মিষ্টি দিয়ে পেপসি তৈরি করে কয়েক হাজার মানুষকে খাইয়ে তাদের মতামত নিয়ে একটা গ্রাফ তৈরি করলেই তো মিটে যায়। যে পয়েন্টের চার দিকে বেশির ভাগ মতামত কেন্দ্রীভূত হবে, সেটাই সঠিক মাত্রার মিষ্টি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হলো না। অর্থাৎ কাস্টমারদের মতামত গ্রাফের সব জায়গায় এমন এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে সেখান থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা গেল না। হাওয়ার্ডের মতো যারা এ ধরনের কাজ করেন, এসব ক্ষেত্রে তারা একটা আন্দাজ করে নেন। যেমন, এ ক্ষেত্রে তারা ৮ ও ১২-এর মাঝামাঝি ১০-কে বেছে নিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতেন। কিন্তু হাওয়ার্ড সেটা করলেন না।

এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কয়েক বছর চলে যাওয়ার পর একদিন হাওয়ার্ডের মাথায় হঠাৎ বিদ্যুতের মতো নতুন একটা ধারণা খেলে গেল। তিনি পেপসি কোম্পানির কর্মকর্তাদের গিয়ে বললেন, তাদের চাওয়ার মধ্যেই একটা গলদ আছে। তারা সবার জন্য কেবল এক ধরনের পেপসি খুঁজছিলেন, কিন্তু এক ধরনের পেপসি দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের পেপসি লাগবে। শুধু পেপসি কোম্পানি নয়, সবাই তাকে উন্মাদ ঠাওরাল। কিন্তু তিনি দমে না গিয়ে তার কথা বলতেই থাকলেন। উলটো সবাইকে সমালোচনা করে বললেন, ‘টু এ ওয়ার্ম ইন হর্সরেডিশ, দি ওয়ার্ল্ড ইজ হর্সরেডিশ’-মানুষ যাতে অভ্যস্ত তার বাইরে সে আর কিছু ভাবতে পারে না।

এরপর ভ্লাসিক পিকল নামের আরেকটি কোম্পানি এসে বলল, তাদের একটা আচারের স্বাদ যেন নিখুঁত হয় সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কিন্তু হাওয়ার্ডের ওই এক কথা। কোনো এক ধরনের আচার কোনো দিনই সবার কাছে নিখুঁত হবে না। একাধিক ধরনের কথা ভাবতে হবে। তৈরি হলো নতুন আচার-‘জেস্টি পিকল’। এরপর ক্যাম্পবেল সুপ নামের একটি কোম্পানি হাওয়ার্ডের পরামর্শ চাইল। তাদের ‘প্রেগু’ নামের একটি স্প্যাগেটি সস ‘রাগু’ সসের সঙ্গে পেরে উঠছে না। যদিও গুণাগুণ বিচারে ‘রাগু’র চেয়ে ‘প্রেগু’ ভালো, কিন্তু জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে ‘রাগু’ অনেক এগিয়ে ছিল। হাওয়ার্ড চ্যালেঞ্জটা নিলেন। তিনি প্রথমেই মিষ্টি, টক, রসুন, টমেটো ইত্যাদি বাড়িয়ে কমিয়ে ৪৫ ধরনের স্প্যাগেটি সস তৈরি করে ফেললেন। তারপর কয়েক মাস ধরে সারা দেশ ঘুরে ঘুরে তা হাজার হাজার মানুষকে খাইয়ে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করলেন।

তিনি দেখলেন সব আমেরিকান এক ধরনের সস পছন্দ করে না। কেউ পছন্দ করে প্লেইন সস, কেউ স্পাইসি; আবার কারও ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ ভালো লাগে। তিনি এই তিন ধরনের সস বানাতে বললেন। প্রথম দুটির ব্যাপারে ক্যাম্পবেল খুব একটা আপত্তি করল না, কারণ ওগুলো পরিচিত। কিন্তু তাদের আপত্তি ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ নিয়ে। ওরকম সস তো কেউ কোনো দিন খায়নি। তাহলে ওটা বাজারে ছাড়া কি ঠিক হবে! কিন্তু হাওয়ার্ড গোঁ ধরে বসে রইলেন। ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ বাজারে এলো এবং এসেই বাজিমাত করে দিল। পরবর্তী ১০ বছরে শুধু ওই ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ ৬০০ মিলিয়ন ডলার মুনাফা করল। এরপর প্রায় সবাই হাওয়ার্ডের পথ ধরল, এমনকি রাগুও। এখন বাজারে প্রায় ৩৬ রকমের রাগু আছে।

হাওয়ার্ড ক্রেতাদের পছন্দ জানার পদ্ধতিটাই পালটে দিলেন। আগে ওদের জিজ্ঞেস করা হতো, তারা কী খেতে পছন্দ করে? আর হাওয়ার্ড আগে নতুন জিনিস বানিয়ে তাদের খাইয়ে তারপর তাদের মতামত নিলেন। হাওয়ার্ড বুঝলেন, এভাবে না খাওয়ালে ক্রেতারা বলতে পারবে না তারা আসলে কী চায়। ‘মন জানে না রসনা কী চায়’। যেমন, কী ধরনের কফি খেতে চায় জিজ্ঞেস করলেই নাকি মানুষ কড়া কালো কফির কথা বলে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ হালকা দুধ কফি পছন্দ করে।

হাওয়ার্ড আরেকটি যে গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন সেটা হচ্ছে, খাদ্য উপাদানের ভালো-মন্দ নেই। যেমন, ভালো বা খারাপ সরিষা বলে কিছু নেই। আছে নানা রকম সরিষা। একজনের কাছে যে সরিষা ভালো লাগে, অন্যের কাছে সেটা ভালো নাও লাগতে পারে।

হাওয়ার্ডের আরেকটা কথাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি বললেন, বিশ্বজনীন কোনো ভালো বা খারাপ খাবার নেই। রাগু বা প্রেগু আগে ইতালিয়ান সস বানাত। তারা ধরেই নিয়েছিল, সস মানেই ইতালিয়ান সস এবং মানুষ ওটাই পছন্দ করবে। এরকম বিশ্বজনীনতার ধারণা সব ক্ষেত্রেই ছিল। ১৯ ও ২০-এর শতকে মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, অর্থনীতি-সব জায়গাতেই বিশ্বজনীন কোনো কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এখন বিজ্ঞান শুধু বিশ্বজনীন বিষয়ের সন্ধান করে না, বৈচিত্র্য খোঁজে। যেমন, এখন ক্যানসারের সর্বজনীন রূপের চেয়ে একজন ব্যক্তির দেহে বিশেষ কী ধরনের ক্যানসার আছে সেটা বোঝার চেষ্টা করা হয়।

হাওয়ার্ডের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে আমাদের এবং অন্য কিছু দেশের নতুন শিক্ষাক্রমের মৌলিক মিল আছে। হাওয়ার্ড যেমন সব কাস্টমারকে এক করে দেখেননি, এই শিক্ষাক্রমগুলোও সব শিক্ষার্থীকে একভাবে দেখছে না। হাওয়ার্ড যেমন ক্রেতাদের বৈচিত্র্য ও রুচিকে শ্রদ্ধা করে তাদের মতো করে খাদ্যপণ্য তৈরি করেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমেও শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্য ও মেধাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের মতো করে শেখানোর চেষ্টা করা হবে। হাওয়ার্ড যেমন বলেছেন, ভালো বা খারাপ খাদ্য উপাদান বলে কিছু নেই, তেমনি নতুন শিক্ষাক্রমের চোখে ভালো বা খারাপ শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই। হাওয়ার্ড যেমন বলেছেন, এক ধরনের খাবার সবার কাছে নিখুঁত মনে হবে না, তেমনি শুধু একাডেমিক অর্থে সব শিক্ষার্থী ভালো হয় না।

হাওয়ার্ডের কাস্টমাররা যেমন নিজেরাই জানত না তাদের ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ ভালো লাগবে, শিক্ষার্থীরাও তাদের নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে না। একাডেমিক ক্ষেত্রে দুর্বল হলেই তারা নিজেদের মেধাহীন মনে করে। অথচ একাডেমিক দিকটা গুণগত শিক্ষার একটি অংশমাত্র। তারা জানে না তাদের অন্য মেধা আছে। হাওয়ার্ডের মতো এখন একজন শিক্ষককেও দেখিয়ে দিতে হবে কোন ধরনের মেধা নিয়ে তারা জন্মেছে বা বড় হয়েছে। তারা যে চাইলেই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের মেধাবী প্রমাণ করতে পারে, তাদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দিতে হবে। সর্বোপরি তারা যেন নিজেদের চেষ্টায় তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে হবে।

শুধু হাওয়ার্ড নন, এ যুগে একজন ভালো চিকিৎসক যেভাবে রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার চিকিৎসা করেন, একজন প্রতিভাবান শিল্পী যেভাবে ব্যক্তিমানুষের পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনা করে তার শিল্প সৃষ্টি করেন, একজন দক্ষ রাষ্ট্রনেতা যেভাবে জনগণের কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, একজন শিক্ষককেও তা-ই করতে হবে। তাকে মনে রাখতে হবে, তিনি নিজে আর শিক্ষার কেন্দ্রে অবস্থান করবেন না, শিক্ষার কেন্দ্রে থাকবে শিক্ষার্থী। তার কাজ হচ্ছে মূলত তিনটি : শিক্ষার্থীকে তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করা, তার ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেওয়া, এবং তার মেধাকে বিকশিত করার প্রক্রিয়ায় তার পাশে থেকে তাকে সাহায্য করা।

সৈয়দ মো গোলাম ফারুক : মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক

শিক্ষাক্রমে বিচিত্র মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

কিছু দিন আগ পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে যত শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়েছে, সেগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের একাডেমিক মেধার বিকাশ ঘটানো।

হাওয়ার্ড গার্ডনার মানুষের যে আট রকম মেধার কথা বলেছেন, তার ভেতর কেবল দুই-তিন ধরনের মেধা বা যাদের এ দুই-তিন ধরনের মেধা আছে তাদের প্রতিই নজর দেওয়া হতো। কিন্তু এখন শিক্ষায় উন্নত দেশগুলো বা তাদের দেখাদেখি যারা শিক্ষায় উন্নত হতে চাচ্ছে, তারা শিক্ষার্থীদের যত ধরনের মেধা আছে তার সব দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করছে। মূলত দুটি কারণে এ কাজটি করতে হচ্ছে। একটি হচ্ছে, ২১ শতকের বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং অপরটি গত শতকের হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের প্রভাব।

হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টকে বিবেচনায় নিলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মেধাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এই ২১ শতকে টিকতে হলে শুধু একাডেমিক নয়, সব শিক্ষার্থীর সব ধরনের মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে। এ মুভমেন্ট ইতোমধ্যেই সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সৌন্দর্য তত্ত্বে এখন ব্যক্তিমানুষের চোখে যা ভালো লাগে তাকেই সুন্দর বলে মনে করা হয়। একইভাবে একটি গণতান্ত্রিক দেশে ভোটার যে দলের পক্ষে রায় দেয়, তারাই দেশ পরিচালনার অধিকার পায়। একজন চিকিৎসকও চিকিৎসা করার সময় রোগীর পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করেন। আর ব্যবসায়ীরা যে ‘কাস্টমার যা চায় তাই সই’ নীতি অবলম্বন করে চলেন, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ব্যবসায় কীভাবে এই হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের প্রভাব পড়েছে তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। হাওয়ার্ড মস্কোউইটজ নামের একজন সাইকোফিজিসিস্ট খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে কাস্টমারদের পছন্দ মাপার কাজ করতেন। একবার তার কাছে পেপসি কোম্পানি আসে তাদের নতুন প্রডাক্ট ‘ডায়েট পেপসি’র মিষ্টির মাত্রা নির্ধারণ করতে। ডায়েট পেপসিতে মিষ্টি স্বাদ যোগ করার জন্য এস্পাটিম বলে একটি রাসায়নিক পদার্থ মেশাতে হয়। এখন কতটুকু এসপাটিম যোগ করলে কাস্টমারদের কাছে মিষ্টির পরিমাণ সঠিক মাত্রার মনে হবে, তা জানতেই হাওয়ার্ডের শরণাপন্ন হওয়া। পেপসির মতো পানীয় কতটুকু মিষ্টি হতে পারে তার একটা সীমা আছে। আট শতাংশের নিচে হলে তা যে মিষ্টি সেটাই বোঝা যাবে না, আর ১২ শতাংশের বেশি হলে তা এত বেশি হবে যে খাওয়াই যাবে না। এখন হাওয়ার্ডকে ৮ ও ১২-এর মধ্যে এমন একটা মাত্রা খুঁজে বের করতে হবে যাতে সবাই তা পান করতে আগ্রহী হয়।

হাওয়ার্ডের মনে হলো কাজটা সোজা। আট থেকে শুরু করে নানা মাত্রার (৮.১, ৮.২, ৮.৩…১২) মিষ্টি দিয়ে পেপসি তৈরি করে কয়েক হাজার মানুষকে খাইয়ে তাদের মতামত নিয়ে একটা গ্রাফ তৈরি করলেই তো মিটে যায়। যে পয়েন্টের চার দিকে বেশির ভাগ মতামত কেন্দ্রীভূত হবে, সেটাই সঠিক মাত্রার মিষ্টি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হলো না। অর্থাৎ কাস্টমারদের মতামত গ্রাফের সব জায়গায় এমন এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে সেখান থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা গেল না। হাওয়ার্ডের মতো যারা এ ধরনের কাজ করেন, এসব ক্ষেত্রে তারা একটা আন্দাজ করে নেন। যেমন, এ ক্ষেত্রে তারা ৮ ও ১২-এর মাঝামাঝি ১০-কে বেছে নিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতেন। কিন্তু হাওয়ার্ড সেটা করলেন না।

এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কয়েক বছর চলে যাওয়ার পর একদিন হাওয়ার্ডের মাথায় হঠাৎ বিদ্যুতের মতো নতুন একটা ধারণা খেলে গেল। তিনি পেপসি কোম্পানির কর্মকর্তাদের গিয়ে বললেন, তাদের চাওয়ার মধ্যেই একটা গলদ আছে। তারা সবার জন্য কেবল এক ধরনের পেপসি খুঁজছিলেন, কিন্তু এক ধরনের পেপসি দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের পেপসি লাগবে। শুধু পেপসি কোম্পানি নয়, সবাই তাকে উন্মাদ ঠাওরাল। কিন্তু তিনি দমে না গিয়ে তার কথা বলতেই থাকলেন। উলটো সবাইকে সমালোচনা করে বললেন, ‘টু এ ওয়ার্ম ইন হর্সরেডিশ, দি ওয়ার্ল্ড ইজ হর্সরেডিশ’-মানুষ যাতে অভ্যস্ত তার বাইরে সে আর কিছু ভাবতে পারে না।

এরপর ভ্লাসিক পিকল নামের আরেকটি কোম্পানি এসে বলল, তাদের একটা আচারের স্বাদ যেন নিখুঁত হয় সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কিন্তু হাওয়ার্ডের ওই এক কথা। কোনো এক ধরনের আচার কোনো দিনই সবার কাছে নিখুঁত হবে না। একাধিক ধরনের কথা ভাবতে হবে। তৈরি হলো নতুন আচার-‘জেস্টি পিকল’। এরপর ক্যাম্পবেল সুপ নামের একটি কোম্পানি হাওয়ার্ডের পরামর্শ চাইল। তাদের ‘প্রেগু’ নামের একটি স্প্যাগেটি সস ‘রাগু’ সসের সঙ্গে পেরে উঠছে না। যদিও গুণাগুণ বিচারে ‘রাগু’র চেয়ে ‘প্রেগু’ ভালো, কিন্তু জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে ‘রাগু’ অনেক এগিয়ে ছিল। হাওয়ার্ড চ্যালেঞ্জটা নিলেন। তিনি প্রথমেই মিষ্টি, টক, রসুন, টমেটো ইত্যাদি বাড়িয়ে কমিয়ে ৪৫ ধরনের স্প্যাগেটি সস তৈরি করে ফেললেন। তারপর কয়েক মাস ধরে সারা দেশ ঘুরে ঘুরে তা হাজার হাজার মানুষকে খাইয়ে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করলেন।

তিনি দেখলেন সব আমেরিকান এক ধরনের সস পছন্দ করে না। কেউ পছন্দ করে প্লেইন সস, কেউ স্পাইসি; আবার কারও ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ ভালো লাগে। তিনি এই তিন ধরনের সস বানাতে বললেন। প্রথম দুটির ব্যাপারে ক্যাম্পবেল খুব একটা আপত্তি করল না, কারণ ওগুলো পরিচিত। কিন্তু তাদের আপত্তি ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ নিয়ে। ওরকম সস তো কেউ কোনো দিন খায়নি। তাহলে ওটা বাজারে ছাড়া কি ঠিক হবে! কিন্তু হাওয়ার্ড গোঁ ধরে বসে রইলেন। ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ বাজারে এলো এবং এসেই বাজিমাত করে দিল। পরবর্তী ১০ বছরে শুধু ওই ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ ৬০০ মিলিয়ন ডলার মুনাফা করল। এরপর প্রায় সবাই হাওয়ার্ডের পথ ধরল, এমনকি রাগুও। এখন বাজারে প্রায় ৩৬ রকমের রাগু আছে।

হাওয়ার্ড ক্রেতাদের পছন্দ জানার পদ্ধতিটাই পালটে দিলেন। আগে ওদের জিজ্ঞেস করা হতো, তারা কী খেতে পছন্দ করে? আর হাওয়ার্ড আগে নতুন জিনিস বানিয়ে তাদের খাইয়ে তারপর তাদের মতামত নিলেন। হাওয়ার্ড বুঝলেন, এভাবে না খাওয়ালে ক্রেতারা বলতে পারবে না তারা আসলে কী চায়। ‘মন জানে না রসনা কী চায়’। যেমন, কী ধরনের কফি খেতে চায় জিজ্ঞেস করলেই নাকি মানুষ কড়া কালো কফির কথা বলে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ হালকা দুধ কফি পছন্দ করে।

হাওয়ার্ড আরেকটি যে গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন সেটা হচ্ছে, খাদ্য উপাদানের ভালো-মন্দ নেই। যেমন, ভালো বা খারাপ সরিষা বলে কিছু নেই। আছে নানা রকম সরিষা। একজনের কাছে যে সরিষা ভালো লাগে, অন্যের কাছে সেটা ভালো নাও লাগতে পারে।

হাওয়ার্ডের আরেকটা কথাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি বললেন, বিশ্বজনীন কোনো ভালো বা খারাপ খাবার নেই। রাগু বা প্রেগু আগে ইতালিয়ান সস বানাত। তারা ধরেই নিয়েছিল, সস মানেই ইতালিয়ান সস এবং মানুষ ওটাই পছন্দ করবে। এরকম বিশ্বজনীনতার ধারণা সব ক্ষেত্রেই ছিল। ১৯ ও ২০-এর শতকে মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, অর্থনীতি-সব জায়গাতেই বিশ্বজনীন কোনো কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এখন বিজ্ঞান শুধু বিশ্বজনীন বিষয়ের সন্ধান করে না, বৈচিত্র্য খোঁজে। যেমন, এখন ক্যানসারের সর্বজনীন রূপের চেয়ে একজন ব্যক্তির দেহে বিশেষ কী ধরনের ক্যানসার আছে সেটা বোঝার চেষ্টা করা হয়।

হাওয়ার্ডের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে আমাদের এবং অন্য কিছু দেশের নতুন শিক্ষাক্রমের মৌলিক মিল আছে। হাওয়ার্ড যেমন সব কাস্টমারকে এক করে দেখেননি, এই শিক্ষাক্রমগুলোও সব শিক্ষার্থীকে একভাবে দেখছে না। হাওয়ার্ড যেমন ক্রেতাদের বৈচিত্র্য ও রুচিকে শ্রদ্ধা করে তাদের মতো করে খাদ্যপণ্য তৈরি করেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমেও শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্য ও মেধাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের মতো করে শেখানোর চেষ্টা করা হবে। হাওয়ার্ড যেমন বলেছেন, ভালো বা খারাপ খাদ্য উপাদান বলে কিছু নেই, তেমনি নতুন শিক্ষাক্রমের চোখে ভালো বা খারাপ শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই। হাওয়ার্ড যেমন বলেছেন, এক ধরনের খাবার সবার কাছে নিখুঁত মনে হবে না, তেমনি শুধু একাডেমিক অর্থে সব শিক্ষার্থী ভালো হয় না।

হাওয়ার্ডের কাস্টমাররা যেমন নিজেরাই জানত না তাদের ‘এক্সট্রা চাঙ্কি’ ভালো লাগবে, শিক্ষার্থীরাও তাদের নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে না। একাডেমিক ক্ষেত্রে দুর্বল হলেই তারা নিজেদের মেধাহীন মনে করে। অথচ একাডেমিক দিকটা গুণগত শিক্ষার একটি অংশমাত্র। তারা জানে না তাদের অন্য মেধা আছে। হাওয়ার্ডের মতো এখন একজন শিক্ষককেও দেখিয়ে দিতে হবে কোন ধরনের মেধা নিয়ে তারা জন্মেছে বা বড় হয়েছে। তারা যে চাইলেই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের মেধাবী প্রমাণ করতে পারে, তাদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দিতে হবে। সর্বোপরি তারা যেন নিজেদের চেষ্টায় তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে হবে।

শুধু হাওয়ার্ড নন, এ যুগে একজন ভালো চিকিৎসক যেভাবে রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার চিকিৎসা করেন, একজন প্রতিভাবান শিল্পী যেভাবে ব্যক্তিমানুষের পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনা করে তার শিল্প সৃষ্টি করেন, একজন দক্ষ রাষ্ট্রনেতা যেভাবে জনগণের কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, একজন শিক্ষককেও তা-ই করতে হবে। তাকে মনে রাখতে হবে, তিনি নিজে আর শিক্ষার কেন্দ্রে অবস্থান করবেন না, শিক্ষার কেন্দ্রে থাকবে শিক্ষার্থী। তার কাজ হচ্ছে মূলত তিনটি : শিক্ষার্থীকে তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করা, তার ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেওয়া, এবং তার মেধাকে বিকশিত করার প্রক্রিয়ায় তার পাশে থেকে তাকে সাহায্য করা।

সৈয়দ মো গোলাম ফারুক : মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক