শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তরে শিক্ষকের নেতৃত্ব কতটা স্বীকৃত

 কাজী ফারুক আহমেদ

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কো নির্ধারিত একটি প্রতিপাদ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে দেশে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি, শিক্ষক সংগঠন এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করে থাকে।

তবে সব দেশে একই দিনে তা পালিত হয় না। বাংলাদেশ, বাহরাইন, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, কানাডা, জার্মানি, মিয়ানমার, পাকিস্তান, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে ৫ অক্টোবর দিনটি পালিত হয়। অবশ্য বাংলাদেশে আজ দুর্গাপূজার কারণে উদযাপন কর্মসূচি অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্ব শিক্ষক দিবস জাতীয় উদযাপন কমিটি সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য, ২০১১ সাল থেকে এ কমিটির ব্যানারে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, আইএলওসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষা নিয়ে কর্মরত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। ভারতে দিনটি পালিত হয় এক মাস আগে, রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরে।

কেন ৫ অক্টোবর

১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনে তৎকালীন মহাপরিচালক ফেডোরিকো মেয়রের প্রস্তাবক্রমে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারগুলোর সভায় শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও করণীয় সম্পর্কে গৃহীত ও পরবর্তী সময়ে আইএলও কর্তৃক অনুমোদিত সুপারিশগুলো চিরস্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি উদযাপন শুরু হয়। তবে ১৯৬৬ সালের ১৪৫ ধারাসংবলিত সুপারিশমালায় নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক, কারিগরি, বৃত্তিমূলক, চারুকলাসহ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠদানকারী সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলেও উচ্চতর শিক্ষাদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের কথা সুনির্দিষ্ট উল্লেখ না থাকায় ১৯৯৭ সালের ১৫ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর এক বিশেষ অধিবেশনে উচ্চতর শিক্ষাদানকারী শিক্ষকদের মর্যাদাসংক্রান্ত সুপারিশ যুক্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে গৃহীত উভয় সুপারিশমালাই ‘শিক্ষকদের মর্যাদা সনদ’ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং বিশ্বব্যাপী সর্বস্তরের শিক্ষকরা ওই সনদের স্মারক দিবস হিসাবে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন করবেন। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষকরা বর্তমানে দিবসটি পালন করে থাকেন।

উল্লেখযোগ্য ছয় বিষয়

শিক্ষকদের ‘মর্যাদা সনদ’ হিসাবে ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশকৃত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে : ১. সামগ্রিক জনস্বার্থে যেহেতু শিক্ষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেহেতু শিক্ষাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসাবে স্বীকার করতে হবে। যেহেতু শিক্ষা অর্থনৈতিক উন্নতির অপরিহার্য উপাদান, তাই শিক্ষা পরিকল্পনা সমগ্র অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। ২. কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত দ্বারা শিক্ষকদের পেশাজীবন ও অবস্থান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পেশাগত অসদাচরণের জন্য কোনো শিক্ষকের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রযোজ্য বলে বিবেচিত হলে অসদাচরণের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. কারও সম্পর্কে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয় স্থিরকৃত হলে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্ধারিত কর্তৃপক্ষকে শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ৪. পেশাগত দায়িত্ব পালনে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা থাকতে হবে। ৫. শিক্ষকরা এবং সংগঠনগুলো যৌথভাবে নতুন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণের উন্নয়ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন। ৬. একজন শিক্ষকের প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে কত ঘণ্টা কাজ করা প্রয়োজন, তা শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হওয়া উচিত। শিক্ষকদের বেতন এমন হওয়া উচিত, যা সমাজে শিক্ষকতা পেশার গুরুত্ব ও মর্যাদাকে তুলে ধরে।

শিক্ষকরা কতটা অধিকার ও করণীয় সচেতন

১৯৯৪ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্যতম কারণ ছিল ১৯৬৬ সালের ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশকৃত শিক্ষকদের অধিকার, করণীয় ও মর্যাদাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর দিকে শিক্ষক, অভিভাবক, নীতিপ্রণেতা, প্রশাসন-সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু যাদের জন্য এসব সুপারিশ, তারা কতজন এ বিষয়ে অবগত? এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল এ নিয়ে বিভিন্ন দেশে একাধিক জরিপ চালিয়েছে। এতে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ শিক্ষক সংগঠনের সদস্য জানলেও ১০ শতাংশ শিক্ষকের এগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। অন্যদিকে ১০ শতাংশ শিক্ষক আদৌ অবহিত নন যে, তাদের জন্য এ ধরনের নীতিমালা বা গুচ্ছ সুপারিশ রয়েছে।

শিক্ষার মান : শিক্ষক ও সংগঠন

অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও শিক্ষকদের মধ্যে তাদের সংগঠনগুলোয় এবং শিক্ষকদের নিয়ে সরকার, নীতিপ্রণেতা, অভিভাবক সবার মধ্যে প্রচলিত অবস্থানে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের অথবা তাদের সংগঠনগুলোর যে কোনো ভূমিকা আছে বা থাকতে পারে, তার স্বীকৃতি নেই। আবার শিক্ষার জন্যই যে শিক্ষকের প্রয়োজন, শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে না পারলে বা গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষক যে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন না-শিক্ষকদের মধ্যেও এ উপলব্ধি বলা চলে ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত।

পেশাগত দাবি নিয়ে ধ্বনি উচ্চারণ ও দাবি আদায়ের কর্মসূচির বাইরে শিক্ষার উন্নয়নে, মান বৃদ্ধিতে শিক্ষক সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য, ধারাবাহিক ভূমিকা ও কর্মসূচি গ্রহণের ইতিহাস সেজন্য কমবেশি সাম্প্রতিক। বড়জোর তিন দশকের। পাঠক্রম অনুসারে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে যে পাঠদান করেন, শিক্ষার্থী তার কতটা অনুভবে নিতে পারল, আয়ত্ত করতে বা ধারণে সক্ষম হলো, তার মূল্যায়ন যথাযথ হচ্ছে কি না অথবা কীভাবে হওয়া সম্ভব, তা নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলোকে সম্মিলিতভাবে প্রস্তাব দিতে দেখা যায় মাত্র দুই দশক আগে।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে শিক্ষকদের পেশাগত ১৫ দফা দাবির সঙ্গে যুক্ত করে পরীক্ষা সংস্কারে সাত দফা এবং পরবর্তী সময়ে শিক্ষাজীবন সমাপনকারী শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টিও শিক্ষার্থীদের দাবিনামায় অন্তর্ভুক্ত করে। সে লক্ষ্যে শিক্ষা, অর্থ, পরিকল্পনা ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু তখনকার সরকার তো বটেই, কেউই একে আমলে নেয়নি।

এ বছর শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে-‘শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষার রূপান্তর শুরু’। অতিমারি করোনার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সব বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বব্যাপী শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে যেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, অভিভাবকদের সঙ্গে নৈকট্য ও সংযোগ রক্ষা করে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তি ও দূরশিক্ষণ আয়ত্তকরণ ও অভ্যস্ততা অর্জনে নিজেদের যেভাবে পরিচালিত ও পরিবর্তিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন, তার প্রতি স্বীকৃতি দিয়েই এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে।

অনেকেই বলেন, গত কয়েক দশকের তুলনায় দেশের শিক্ষকসমাজ এখন ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু প্রায়ই শিক্ষকদের প্রতি নির্যাতন ও অসম্মান করার যেসব খবর পাওয়া যায়, তা আমাদের ভাবিত করে বৈকি। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের অবস্থার তুলনামূলক উন্নয়ন মেনে নিয়েও বলতে হয়, আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতাকে জয় করে সামনে এগোতে গেলে শিক্ষায় এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে; বরাদ্দের সদ্ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষকদের ভূমিকা যেমন সরকারকে মেনে নিতে হবে, তেমনই শিক্ষকদেরও দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের পুরোনো ধ্যানধারণা ভাঙতে হবে, পাশাপাশি শিক্ষার উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত হতে হবে। অতিমারি করোনার মতো অভাবিত সংকট অব্যাহত থাকাকালে তারা যে সাহস, মনোবল ও অসীম ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা অব্যাহত রাখতে হবে। আমি শিক্ষকদের নীতিগত অনমনীয়তা ও ঐকান্তিকতায় পূর্ণ আস্থাবান। দেশে দেশে শিক্ষকদের অবস্থান এবং বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য তাদের বেশি করে শক্তি ও সাহস জোগাবে, এ বিশ্বাস আমার আছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস অমর হোক।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অন্যতম প্রণেতা; এডুকেশন ওয়াচ বাংলাদেশের অন্যতম সদস্য

শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তরে শিক্ষকের নেতৃত্ব কতটা স্বীকৃত

 কাজী ফারুক আহমেদ

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কো নির্ধারিত একটি প্রতিপাদ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে দেশে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি, শিক্ষক সংগঠন এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করে থাকে।

তবে সব দেশে একই দিনে তা পালিত হয় না। বাংলাদেশ, বাহরাইন, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, কানাডা, জার্মানি, মিয়ানমার, পাকিস্তান, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে ৫ অক্টোবর দিনটি পালিত হয়। অবশ্য বাংলাদেশে আজ দুর্গাপূজার কারণে উদযাপন কর্মসূচি অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্ব শিক্ষক দিবস জাতীয় উদযাপন কমিটি সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য, ২০১১ সাল থেকে এ কমিটির ব্যানারে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, আইএলওসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষা নিয়ে কর্মরত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। ভারতে দিনটি পালিত হয় এক মাস আগে, রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরে।

কেন ৫ অক্টোবর

১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনে তৎকালীন মহাপরিচালক ফেডোরিকো মেয়রের প্রস্তাবক্রমে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারগুলোর সভায় শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও করণীয় সম্পর্কে গৃহীত ও পরবর্তী সময়ে আইএলও কর্তৃক অনুমোদিত সুপারিশগুলো চিরস্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি উদযাপন শুরু হয়। তবে ১৯৬৬ সালের ১৪৫ ধারাসংবলিত সুপারিশমালায় নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক, কারিগরি, বৃত্তিমূলক, চারুকলাসহ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠদানকারী সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলেও উচ্চতর শিক্ষাদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের কথা সুনির্দিষ্ট উল্লেখ না থাকায় ১৯৯৭ সালের ১৫ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর এক বিশেষ অধিবেশনে উচ্চতর শিক্ষাদানকারী শিক্ষকদের মর্যাদাসংক্রান্ত সুপারিশ যুক্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে গৃহীত উভয় সুপারিশমালাই ‘শিক্ষকদের মর্যাদা সনদ’ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং বিশ্বব্যাপী সর্বস্তরের শিক্ষকরা ওই সনদের স্মারক দিবস হিসাবে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন করবেন। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষকরা বর্তমানে দিবসটি পালন করে থাকেন।

উল্লেখযোগ্য ছয় বিষয়

শিক্ষকদের ‘মর্যাদা সনদ’ হিসাবে ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশকৃত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে : ১. সামগ্রিক জনস্বার্থে যেহেতু শিক্ষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেহেতু শিক্ষাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসাবে স্বীকার করতে হবে। যেহেতু শিক্ষা অর্থনৈতিক উন্নতির অপরিহার্য উপাদান, তাই শিক্ষা পরিকল্পনা সমগ্র অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। ২. কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত দ্বারা শিক্ষকদের পেশাজীবন ও অবস্থান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পেশাগত অসদাচরণের জন্য কোনো শিক্ষকের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রযোজ্য বলে বিবেচিত হলে অসদাচরণের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. কারও সম্পর্কে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয় স্থিরকৃত হলে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্ধারিত কর্তৃপক্ষকে শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ৪. পেশাগত দায়িত্ব পালনে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা থাকতে হবে। ৫. শিক্ষকরা এবং সংগঠনগুলো যৌথভাবে নতুন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণের উন্নয়ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন। ৬. একজন শিক্ষকের প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে কত ঘণ্টা কাজ করা প্রয়োজন, তা শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হওয়া উচিত। শিক্ষকদের বেতন এমন হওয়া উচিত, যা সমাজে শিক্ষকতা পেশার গুরুত্ব ও মর্যাদাকে তুলে ধরে।

শিক্ষকরা কতটা অধিকার ও করণীয় সচেতন

১৯৯৪ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্যতম কারণ ছিল ১৯৬৬ সালের ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশকৃত শিক্ষকদের অধিকার, করণীয় ও মর্যাদাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর দিকে শিক্ষক, অভিভাবক, নীতিপ্রণেতা, প্রশাসন-সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু যাদের জন্য এসব সুপারিশ, তারা কতজন এ বিষয়ে অবগত? এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল এ নিয়ে বিভিন্ন দেশে একাধিক জরিপ চালিয়েছে। এতে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ শিক্ষক সংগঠনের সদস্য জানলেও ১০ শতাংশ শিক্ষকের এগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। অন্যদিকে ১০ শতাংশ শিক্ষক আদৌ অবহিত নন যে, তাদের জন্য এ ধরনের নীতিমালা বা গুচ্ছ সুপারিশ রয়েছে।

শিক্ষার মান : শিক্ষক ও সংগঠন

অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও শিক্ষকদের মধ্যে তাদের সংগঠনগুলোয় এবং শিক্ষকদের নিয়ে সরকার, নীতিপ্রণেতা, অভিভাবক সবার মধ্যে প্রচলিত অবস্থানে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের অথবা তাদের সংগঠনগুলোর যে কোনো ভূমিকা আছে বা থাকতে পারে, তার স্বীকৃতি নেই। আবার শিক্ষার জন্যই যে শিক্ষকের প্রয়োজন, শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে না পারলে বা গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষক যে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন না-শিক্ষকদের মধ্যেও এ উপলব্ধি বলা চলে ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত।

পেশাগত দাবি নিয়ে ধ্বনি উচ্চারণ ও দাবি আদায়ের কর্মসূচির বাইরে শিক্ষার উন্নয়নে, মান বৃদ্ধিতে শিক্ষক সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য, ধারাবাহিক ভূমিকা ও কর্মসূচি গ্রহণের ইতিহাস সেজন্য কমবেশি সাম্প্রতিক। বড়জোর তিন দশকের। পাঠক্রম অনুসারে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে যে পাঠদান করেন, শিক্ষার্থী তার কতটা অনুভবে নিতে পারল, আয়ত্ত করতে বা ধারণে সক্ষম হলো, তার মূল্যায়ন যথাযথ হচ্ছে কি না অথবা কীভাবে হওয়া সম্ভব, তা নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলোকে সম্মিলিতভাবে প্রস্তাব দিতে দেখা যায় মাত্র দুই দশক আগে।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে শিক্ষকদের পেশাগত ১৫ দফা দাবির সঙ্গে যুক্ত করে পরীক্ষা সংস্কারে সাত দফা এবং পরবর্তী সময়ে শিক্ষাজীবন সমাপনকারী শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টিও শিক্ষার্থীদের দাবিনামায় অন্তর্ভুক্ত করে। সে লক্ষ্যে শিক্ষা, অর্থ, পরিকল্পনা ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু তখনকার সরকার তো বটেই, কেউই একে আমলে নেয়নি।

এ বছর শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে-‘শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষার রূপান্তর শুরু’। অতিমারি করোনার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সব বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বব্যাপী শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে যেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, অভিভাবকদের সঙ্গে নৈকট্য ও সংযোগ রক্ষা করে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তি ও দূরশিক্ষণ আয়ত্তকরণ ও অভ্যস্ততা অর্জনে নিজেদের যেভাবে পরিচালিত ও পরিবর্তিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন, তার প্রতি স্বীকৃতি দিয়েই এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে।

অনেকেই বলেন, গত কয়েক দশকের তুলনায় দেশের শিক্ষকসমাজ এখন ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু প্রায়ই শিক্ষকদের প্রতি নির্যাতন ও অসম্মান করার যেসব খবর পাওয়া যায়, তা আমাদের ভাবিত করে বৈকি। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের অবস্থার তুলনামূলক উন্নয়ন মেনে নিয়েও বলতে হয়, আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতাকে জয় করে সামনে এগোতে গেলে শিক্ষায় এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে; বরাদ্দের সদ্ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষকদের ভূমিকা যেমন সরকারকে মেনে নিতে হবে, তেমনই শিক্ষকদেরও দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের পুরোনো ধ্যানধারণা ভাঙতে হবে, পাশাপাশি শিক্ষার উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত হতে হবে। অতিমারি করোনার মতো অভাবিত সংকট অব্যাহত থাকাকালে তারা যে সাহস, মনোবল ও অসীম ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা অব্যাহত রাখতে হবে। আমি শিক্ষকদের নীতিগত অনমনীয়তা ও ঐকান্তিকতায় পূর্ণ আস্থাবান। দেশে দেশে শিক্ষকদের অবস্থান এবং বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য তাদের বেশি করে শক্তি ও সাহস জোগাবে, এ বিশ্বাস আমার আছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস অমর হোক।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অন্যতম প্রণেতা; এডুকেশন ওয়াচ বাংলাদেশের অন্যতম সদস্য