সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকদের ভূমিকা

মোশারফ হোসেন প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান, সরকারি ইস্পাহানী কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, একটি মহান ব্রত। সমাজে যিনি শিক্ষা দান করেন বা যিনি নিজেকে শিক্ষ কতার পেশায় নিয়োজিত করেন তিনি হলেন শিক্ষক। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর সেই মেরুদণ্ড শক্ত করার কারিগর হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষক ছাড়া উন্নত সমাজ, টেকসই উন্নয়ন ও উজ্জ্বল জীবন কল্পনাতীত।

নোবেল বিজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেল শিক্ষকদের সভ্যতার অভিভাবক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেনে। শিক্ষক হিসেবে পৃথিবীতে কেউ জন্মান না, বরং বিশেষ প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়। একজন আদর্শ শিক্ষক জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক হবেন শিক্ষাব্রতী, নিরহংকারী, ছাত্রদরদি, দেশদরদি, সৎ, বিশ্বস্ত, আদর্শবান, চৌকস, দৃঢ়চেতা। তিনি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবেন, হবেন যথার্থ সেবাব্রতী, নিরপেক্ষ, অহমবোধ। তিনি হবেন নৈতিকতা, সততা, ধৈর্য-সহ্যশক্তিসম্পন্ন, কর্মে উদ্দীপনাসম্পন্ন, প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন, সময়নিষ্ঠাবান, প্রাণময়তা ইত্যাদি গুণের অধিকারী। শিক্ষক তাঁর হৃদয়ের অমলিন আনন্দ, আত্মবিশ্বাস, বিষয়ভিত্তিক অর্জিত জ্ঞানসম্পন্ন, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, পেশাগত দক্ষতা, আকর্ষণীয় বাকশৈলীর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত, উজ্জীবিত, সাহস জুগিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবার দীক্ষা দিয়ে থাকেন। অনন্ত উচ্চতায় নিয়ে যাবার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে থাকেন। একজন শিক্ষক হলেন ছাত্রদের প্রতিষ্ঠার স্থপতি। তিনি ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুকরণীয়-বরণীয় ও পথপ্রদর্শক। তাঁদের কাছে সমাজ তথা দেশ ও দশের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। চীনের প্রাচীন নেতা কনফুসিয়াস বলেছেন- “শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি হবেন একজন আদর্শ শাসক।” শিক্ষক সভ্যতার অভিভাবক, সমাজের অভিভাবক।

শিক্ষক অক্লান্ত, পরিশ্রম ত্যাগ-স্বীকার, মূল্যবান সময় উজাড় করে দিয়ে এগিয়ে নিতে জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে অক্লান্তকর্মী হয়ে, অত্যন্ত ধৈর্য, সহনশীলতা, স্নেহ, মায়ামমতা, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। শিক্ষক তিন অক্ষর বিশিষ্ট একটি শব্দ। ‘শি’ মানে শিষ্টাচার, ‘ক্ষ’ মানে ক্ষমাশীল, ‘ক’ মানে কর্তব্যপরায়ণ। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্যকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা বিশ্নেষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বহুবিদ কষ্ট সম্পাদন করেন। তিনি সুযোগ প্রদানকারী, সমস্যা নিরূপণকারী, সমস্যা সমাধানকারী, পরিকল্পনাকারী, পরীক্ষক-নিরীক্ষক, গবেষক, প্রত্যাবেক্ষক, মূল্যায়নকারী, দিকনির্দেশনাকারী, নেতৃত্বদানকারী নেতা, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, পরামর্শদাতা। তিনি মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক, ভালো বক্তা, ভালো শ্রবণকারী, যুক্তিবাদী, অনুভূতিশীল, মনোসংযোগকারী, একজন আজীবন ছাত্র, জ্ঞানপিসাসু, আত্মসমালোচক, আত্মসমীক্ষাকারী, ন্যায়-নিষ্ঠাবান, শিক্ষাক্রম প্রণয়নকারী, অবদানকারী, মনস্তাত্ত্বিক পাঠ পরিকল্পনা-উন্নয়নকারী, পাঠ পরিবেশনাকারী।

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষক সম্পর্কে বলেছেন-

কৌতূহল জাগানো ও কৌতূহল নিবৃত্ত করা শিক্ষকের কাজ। তিনি ছাত্রদের যোগ্য করে তুলে জ্ঞানের দ্বারা তাদের পূর্ণ করেন। এভাবে দান গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটি পবিত্র নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধন সৃষ্টি হয়। সবুজ প্রাণের স্পন্দন জরাজীর্ণতা, নিশ্চলতা, অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে নাশ করে আলোকময় দিনের আলোক প্লাবনে নতুন সূর্য উদিত হয় শিক্ষক সমাজের স্বতঃস্ম্ফূর্ততায়। সভ্যতার শুরু থেকে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে জ্ঞানের আলোক রশ্মি ছড়িয়ে চলছে শিক্ষক সমাজ। তাই ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে শিক্ষক সমাজের সুমহান মর্যাদাস্বীকৃত, বরণীয়-গ্রহণীয়।

তাই বলা যায়, শিক্ষকগণ জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও মূল্যবোধ জাগরণে জাতিকে জাগিয়ে তোলে। সামাজিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট না করে দশ ও দশের উন্নত করে আলোকিত মানুষ, আলোকিত সমাজ গঠন করে মশগুল থেকে স্বপ্ন পূরণের সারথি হন। সৃজনশীল চেতনাবান্ধব শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চায় উপলব্ধি তাঁকে তাড়িত করে। মহৎ কর্মের প্রকাশ ঘটে তাঁর যৌক্তিকবোধ, বিবেক বুদ্ধিদীপ্ততা, তেজদীপ্ততা, সংযম, ধীরস্থিরতা, আবার কখনও তড়িৎকর্মা, ভাব-গাম্ভীর্যতার মধ্য দিয়ে। সংস্কারমনস্কতা, উদারতা, শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ শিক্ষায় পরিপুষ্ট হয়ে দেশের তরে কাজ করে যায় নিরবধি আস্থা-অবিচল থেকে অবলীলায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না একজন আদর্শ শিক্ষক। যে কোনো দেশের শান্তি-উন্নতি-প্রগতি সমৃদ্ধির প্রধানতম শর্ত হলো বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য। শিক্ষক সূর্যের মতো আলো দান করে এবং আলোকময় হয় জাতির সূর্যসন্তান, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষকতা মহৎ পেশা। শিক্ষকরা হচ্ছেন সমস্ত পেশার শিকড়স্বরূপ। তাই এই পেশার দায়িত্বের জায়গাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর কারণ, একজন শিক্ষকের মূল্যবোধ বিনির্মাণের কারিগর বলা হয়। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষকই হচ্ছে শিক্ষার মেরুদণ্ড। সমাজচিন্তক জন ফস্টার বলেন- “শিক্ষা ছাড়া প্রতিভাবন ব্যক্তি অনেকটা খনিতে পড়ে থাকা রুপার মতো।”

জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল শিক্ষাহীন মানুষকে মৃতের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন-

দিশেহারা, দ্বিধাবিভক্ত, জাতিকে একসূত্রে গেঁথে রাখতে তন্দ্রাচ্ছন্ন, তমসাচ্ছন্ন জাতিকে সদা জাগ্রত রাখতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, নব নব চেতনা, গবেষণা-আবিস্কার চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষকগণ বিমোহিনী ঐন্দ্রজালিক, পথপ্রদর্শক, আলোর পথের যাত্রী, সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে নিজেকে ত্যাগের মহিমায় মাহিমান্বিত করে। শিক্ষক সমাজে হয়ে ওঠেন জ্ঞানের মশাল বহনকারী সত্য জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক।

শিক্ষকতা শুধু চাকরি নয়, শিক্ষক মানে আলোকশক্তির আধার। মোমবাতির মতো শেষবিন্দু পর্যন্ত জ্বলে সমাজকে আলোকিত করাই তাঁর ব্রত মহত্ত্ব। শিক্ষকদের কদর করতে হবে। তাঁদের অকদর্য করা মানেই হচ্ছে জাতির প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ বলেছেন-

‘যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না’।

দার্শনিক ও চিন্তাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন- ‘প্রত্যেক শিক্ষকের প্রতি সাত বছরে এক বছর করে ছুটি দেওয়া উচিত, যাতে তিনি অন্যান্য দেশে গিয়ে প্রশিক্ষিত হতে পারেন।’

অন্ধকার আত্মাকে আলোকিত করার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষক হচ্ছেন আলোকবর্তিকা স্বরূপ। তাঁরা জাতি গঠনে এগিয়ে না এলে সমাজ ধ্বংস হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা শিক্ষক সমাজের মর্যাদা বাড়াতে বদ্ধপরিকর- এ জন্য রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। মহান এ পেশায় মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সেবামূলক মনোবৃত্তি নিয়ে শিক্ষক সমাজ এই পেশাকে বেছে নিয়ে থাকেন সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে। তাই শিক্ষকদের মৌলিক চাহিদাগুলো সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তিনি সুস্থির অবস্থানে আসতে পারবেন। সমাজকে এগিয়ে নিতে উৎসাহ পাবেন। মনে রাখতে হবে শিক্ষকগণও মানুষ। তাঁদের মনের যত্ন প্রয়োজন, শারীরিক-মানসিক দিক থেকে সুস্থতা আনয়নে শিক্ষকদের প্রণোদনা দিয়ে মেধাবীদের এই মহান ব্রত উৎসাহিত করলে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পেশাগত উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের যুগোপযোগী এবং সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষক সমাজের আদর্শ আর অতলস্পর্শী জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হবে সমাজ তথা বিশ্ব।

মোশারফ হোসেন: প্রভাষক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকদের ভূমিকা

মোশারফ হোসেন প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান, সরকারি ইস্পাহানী কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, একটি মহান ব্রত। সমাজে যিনি শিক্ষা দান করেন বা যিনি নিজেকে শিক্ষ কতার পেশায় নিয়োজিত করেন তিনি হলেন শিক্ষক। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর সেই মেরুদণ্ড শক্ত করার কারিগর হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষক ছাড়া উন্নত সমাজ, টেকসই উন্নয়ন ও উজ্জ্বল জীবন কল্পনাতীত।

নোবেল বিজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেল শিক্ষকদের সভ্যতার অভিভাবক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেনে। শিক্ষক হিসেবে পৃথিবীতে কেউ জন্মান না, বরং বিশেষ প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়। একজন আদর্শ শিক্ষক জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক হবেন শিক্ষাব্রতী, নিরহংকারী, ছাত্রদরদি, দেশদরদি, সৎ, বিশ্বস্ত, আদর্শবান, চৌকস, দৃঢ়চেতা। তিনি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবেন, হবেন যথার্থ সেবাব্রতী, নিরপেক্ষ, অহমবোধ। তিনি হবেন নৈতিকতা, সততা, ধৈর্য-সহ্যশক্তিসম্পন্ন, কর্মে উদ্দীপনাসম্পন্ন, প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন, সময়নিষ্ঠাবান, প্রাণময়তা ইত্যাদি গুণের অধিকারী। শিক্ষক তাঁর হৃদয়ের অমলিন আনন্দ, আত্মবিশ্বাস, বিষয়ভিত্তিক অর্জিত জ্ঞানসম্পন্ন, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, পেশাগত দক্ষতা, আকর্ষণীয় বাকশৈলীর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত, উজ্জীবিত, সাহস জুগিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবার দীক্ষা দিয়ে থাকেন। অনন্ত উচ্চতায় নিয়ে যাবার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে থাকেন। একজন শিক্ষক হলেন ছাত্রদের প্রতিষ্ঠার স্থপতি। তিনি ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুকরণীয়-বরণীয় ও পথপ্রদর্শক। তাঁদের কাছে সমাজ তথা দেশ ও দশের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। চীনের প্রাচীন নেতা কনফুসিয়াস বলেছেন- “শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি হবেন একজন আদর্শ শাসক।” শিক্ষক সভ্যতার অভিভাবক, সমাজের অভিভাবক।

শিক্ষক অক্লান্ত, পরিশ্রম ত্যাগ-স্বীকার, মূল্যবান সময় উজাড় করে দিয়ে এগিয়ে নিতে জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে অক্লান্তকর্মী হয়ে, অত্যন্ত ধৈর্য, সহনশীলতা, স্নেহ, মায়ামমতা, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। শিক্ষক তিন অক্ষর বিশিষ্ট একটি শব্দ। ‘শি’ মানে শিষ্টাচার, ‘ক্ষ’ মানে ক্ষমাশীল, ‘ক’ মানে কর্তব্যপরায়ণ। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্যকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা বিশ্নেষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বহুবিদ কষ্ট সম্পাদন করেন। তিনি সুযোগ প্রদানকারী, সমস্যা নিরূপণকারী, সমস্যা সমাধানকারী, পরিকল্পনাকারী, পরীক্ষক-নিরীক্ষক, গবেষক, প্রত্যাবেক্ষক, মূল্যায়নকারী, দিকনির্দেশনাকারী, নেতৃত্বদানকারী নেতা, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, পরামর্শদাতা। তিনি মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক, ভালো বক্তা, ভালো শ্রবণকারী, যুক্তিবাদী, অনুভূতিশীল, মনোসংযোগকারী, একজন আজীবন ছাত্র, জ্ঞানপিসাসু, আত্মসমালোচক, আত্মসমীক্ষাকারী, ন্যায়-নিষ্ঠাবান, শিক্ষাক্রম প্রণয়নকারী, অবদানকারী, মনস্তাত্ত্বিক পাঠ পরিকল্পনা-উন্নয়নকারী, পাঠ পরিবেশনাকারী।

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষক সম্পর্কে বলেছেন-

কৌতূহল জাগানো ও কৌতূহল নিবৃত্ত করা শিক্ষকের কাজ। তিনি ছাত্রদের যোগ্য করে তুলে জ্ঞানের দ্বারা তাদের পূর্ণ করেন। এভাবে দান গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটি পবিত্র নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধন সৃষ্টি হয়। সবুজ প্রাণের স্পন্দন জরাজীর্ণতা, নিশ্চলতা, অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে নাশ করে আলোকময় দিনের আলোক প্লাবনে নতুন সূর্য উদিত হয় শিক্ষক সমাজের স্বতঃস্ম্ফূর্ততায়। সভ্যতার শুরু থেকে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে জ্ঞানের আলোক রশ্মি ছড়িয়ে চলছে শিক্ষক সমাজ। তাই ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে শিক্ষক সমাজের সুমহান মর্যাদাস্বীকৃত, বরণীয়-গ্রহণীয়।

তাই বলা যায়, শিক্ষকগণ জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও মূল্যবোধ জাগরণে জাতিকে জাগিয়ে তোলে। সামাজিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট না করে দশ ও দশের উন্নত করে আলোকিত মানুষ, আলোকিত সমাজ গঠন করে মশগুল থেকে স্বপ্ন পূরণের সারথি হন। সৃজনশীল চেতনাবান্ধব শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চায় উপলব্ধি তাঁকে তাড়িত করে। মহৎ কর্মের প্রকাশ ঘটে তাঁর যৌক্তিকবোধ, বিবেক বুদ্ধিদীপ্ততা, তেজদীপ্ততা, সংযম, ধীরস্থিরতা, আবার কখনও তড়িৎকর্মা, ভাব-গাম্ভীর্যতার মধ্য দিয়ে। সংস্কারমনস্কতা, উদারতা, শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ শিক্ষায় পরিপুষ্ট হয়ে দেশের তরে কাজ করে যায় নিরবধি আস্থা-অবিচল থেকে অবলীলায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না একজন আদর্শ শিক্ষক। যে কোনো দেশের শান্তি-উন্নতি-প্রগতি সমৃদ্ধির প্রধানতম শর্ত হলো বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য। শিক্ষক সূর্যের মতো আলো দান করে এবং আলোকময় হয় জাতির সূর্যসন্তান, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষকতা মহৎ পেশা। শিক্ষকরা হচ্ছেন সমস্ত পেশার শিকড়স্বরূপ। তাই এই পেশার দায়িত্বের জায়গাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর কারণ, একজন শিক্ষকের মূল্যবোধ বিনির্মাণের কারিগর বলা হয়। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষকই হচ্ছে শিক্ষার মেরুদণ্ড। সমাজচিন্তক জন ফস্টার বলেন- “শিক্ষা ছাড়া প্রতিভাবন ব্যক্তি অনেকটা খনিতে পড়ে থাকা রুপার মতো।”

জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল শিক্ষাহীন মানুষকে মৃতের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন-

দিশেহারা, দ্বিধাবিভক্ত, জাতিকে একসূত্রে গেঁথে রাখতে তন্দ্রাচ্ছন্ন, তমসাচ্ছন্ন জাতিকে সদা জাগ্রত রাখতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, নব নব চেতনা, গবেষণা-আবিস্কার চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষকগণ বিমোহিনী ঐন্দ্রজালিক, পথপ্রদর্শক, আলোর পথের যাত্রী, সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে নিজেকে ত্যাগের মহিমায় মাহিমান্বিত করে। শিক্ষক সমাজে হয়ে ওঠেন জ্ঞানের মশাল বহনকারী সত্য জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক।

শিক্ষকতা শুধু চাকরি নয়, শিক্ষক মানে আলোকশক্তির আধার। মোমবাতির মতো শেষবিন্দু পর্যন্ত জ্বলে সমাজকে আলোকিত করাই তাঁর ব্রত মহত্ত্ব। শিক্ষকদের কদর করতে হবে। তাঁদের অকদর্য করা মানেই হচ্ছে জাতির প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ বলেছেন-

‘যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না’।

দার্শনিক ও চিন্তাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন- ‘প্রত্যেক শিক্ষকের প্রতি সাত বছরে এক বছর করে ছুটি দেওয়া উচিত, যাতে তিনি অন্যান্য দেশে গিয়ে প্রশিক্ষিত হতে পারেন।’

অন্ধকার আত্মাকে আলোকিত করার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষক হচ্ছেন আলোকবর্তিকা স্বরূপ। তাঁরা জাতি গঠনে এগিয়ে না এলে সমাজ ধ্বংস হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা শিক্ষক সমাজের মর্যাদা বাড়াতে বদ্ধপরিকর- এ জন্য রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। মহান এ পেশায় মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সেবামূলক মনোবৃত্তি নিয়ে শিক্ষক সমাজ এই পেশাকে বেছে নিয়ে থাকেন সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে। তাই শিক্ষকদের মৌলিক চাহিদাগুলো সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তিনি সুস্থির অবস্থানে আসতে পারবেন। সমাজকে এগিয়ে নিতে উৎসাহ পাবেন। মনে রাখতে হবে শিক্ষকগণও মানুষ। তাঁদের মনের যত্ন প্রয়োজন, শারীরিক-মানসিক দিক থেকে সুস্থতা আনয়নে শিক্ষকদের প্রণোদনা দিয়ে মেধাবীদের এই মহান ব্রত উৎসাহিত করলে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পেশাগত উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের যুগোপযোগী এবং সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষক সমাজের আদর্শ আর অতলস্পর্শী জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হবে সমাজ তথা বিশ্ব।

মোশারফ হোসেন: প্রভাষক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা