সৃজনশীল প্রশ্ন বনাম সাম্প্রদায়িকতা

বিগত ৬ নভেম্বর থেকে সারাদেশে সব শিক্ষা বোর্ডের আওতায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে

বিগত ৬ নভেম্বর থেকে সারাদেশে সব শিক্ষা বোর্ডের আওতায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। উক্ত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা (আবশ্যিক) প্রথম প্রশ্নপত্রের প্রথমদিনেই সৃজনশীল নামক প্রশ্নপত্র নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। উল্লিখিত প্রশ্নপত্রের এগারো নম্বর প্রশ্ন নিয়ে মূলধারার মিডিয়াগুলো সর্বস্তরে সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগ উত্থাপিত করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই অভিযোগের পক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, এটি রীতিমতো ধর্মীয় উস্কানির শামিল। ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্র সৃজনশীল ১১ নম্বর প্রশ্নের ঘটনায় জাতি বিব্রত, যার ভেতর দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার একটি কুৎসিত চিত্র ফুটে উঠেছে, যা স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশে কাম্য নয়।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, দেশে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি নিয়ে যেমন সৃজনশীল প্রশ্ন শুরু হয়েছিল এক যুগেরও বেশি সময় অর্থাৎ ২০১০ সালে দেশে বাংলা প্রথম পত্র ও ধর্মশিক্ষা বিষয়ে। ২০১১ সাল থেকে সব বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি পরীক্ষা। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির অন্যতম সংগঠক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতে, ‘যেসব প্রশ্নের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মেধার জড়ত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃষ্টিক্ষম করে তোলা যায়, তার নামই সৃজনশীল প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে পাঠ্যবইয়ে লেখা তথ্য ও ভাবনাগুলো শুধু চিন্তাহীনভাবে মুখস্থ করলে চলবে না, সেগুলো ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং চারপাশের জীবন ও বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দৈনন্দিন জীবনে তার প্রয়োগ করতেও শিখতে হবে।’

এ জন্য প্রতিটি সৃজনশীল প্রশ্নকে ভাগ করা হয় চারটি অংশে। যেমন- প্রশ্নের চতুর্থ অংশে যাচাই করে দেখা হয়, ওই অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত পাঠ্যবইয়ের জায়গাটুকু ও উদ্দীপকের ভেতরকার ভাবনাচিন্তা, অনুভূতি-কল্পনাশক্তি, গভীরতা-ব্যাপকতা ইত্যাদিকে ছাত্রছাত্রীরা তুলনা করে বুঝতে পারছে কি না; এদের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা করে তার নিজস্ব মতামত গড়ে তুলতে পারছে কি না। এই চারটি অংশের মধ্যে প্রথম (জ্ঞানমূলক) এবং দ্বিতীয় (অনুধাবনমূলক) অংশটি পাঠ্যপুস্তক থেকে নেওয়া হয়। তৃতীয় (প্রয়োগমূলক) অংশে ‘উদ্দীপক’ নামক একটি ছোট গদ্যাংশ বা পদ্যাংশ অথবা ছবি, চার্ট, গ্রাফ ইত্যাদি যোগ করা হয়। যার উদ্দেশ্য থাকে উদ্দীপকের অংশ থেকে প্রশ্নের সঠিক প্রয়োগ। চতুর্থ অংশের উদ্দেশ্য পাঠ্যবই এবং উদ্দীপকের ভেতরের অংশের তুলনা করা (প্রথম আলো অনলাইন, ৩১ আগস্ট, ২০১৪)।
আমাদের দেশে বিগত একযুগেরও বেশি সময় ধরে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির বাস্তবায়ন সেভাবে হয়নি। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, সৃজনশীলতার জন্য যে সময় দরকার এবং চিন্তা করার প্রয়াস ঘটানো- এই দুটির কোনোটিই সম্ভব হয়নি কেবল শিক্ষকদের অদক্ষতার কারণে। এই পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে বিবেচনা করা উচিত ছিল সৃজনশীল প্রশ্ন করার জন্য একজন সৃজনশীল শিক্ষক দরকার। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকশিত করার সক্ষমতা একজন শিক্ষকের রয়েছে কি না, সেটাও মাথায় রাখা উচিত ছিল। এ নিয়ে শিক্ষকদের নানা প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরেও সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি, সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকরা দ্বিধাগ্রস্ত। এরই সুযোগ নিচ্ছে অনেক অশুভ শক্তি। যার একটি সহজ পাঠ হলো, যে কোনো একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার। যার একটি ক্ষেত্র হলো শিক্ষা খাত, শিক্ষক, পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ইত্যাদি।
সাম্প্রতিককালে দেশে শিক্ষকের নিগ্রহের /অবমাননার যত ঘটনা ঘটেছে, তার সবই ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষকদের কেন্দ্র করে। যেগুলো ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পদচারণ মাত্র, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এখন আসা যাক সৃজনশীলতার প্রসঙ্গটি নিয়ে, যা এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। যদি নিরপেক্ষ পর্যালোচনায় আসা যায় তা হলে দেখা যাবে যে, পুরো প্রশ্নপত্রই সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে পরিপূর্ণ। যে প্রশ্নকে সৃজনশীল বলা হচ্ছে, সে তো বিন্দুবিসর্গও সৃজনশীল নয়, বরং মুখস্থবিদ্যা কিংবা পুঁথিগত জ্ঞানকে পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দেওয়ার নামান্তর মাত্র। যেমন- মীরজাফর কোন্ দেশ হতে ভারতে আসেন; ‘ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব’- ব্যাখ্যা কর; উদ্দীপকের ‘নেপাল’ চরিত্রের সঙ্গে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ‘মীরজাফর’ চরিত্রের তুলনা কর এবং ‘খাল কেটে কুমির আনা’- প্রবাদটি উদ্দীপক ও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য,-‘উক্তিটির সার্থকতা নিরূপণ কর। এর মধ্যে কী সৃজনশীলতা আছে, সেটি কারও বোধগম্য নয়।

মীরজাফর কোন্ দেশ থেকে ভারতে আসেন, সেটা জানার জন্য স্মৃতিশক্তি দরকার, সৃজনশীলতা নয়। এখানে নেপাল ও গোপাল নামে দুই ভাইয়ের গল্পকে কেন্দ্র করে সিরাজউদ্দৌলা নাটকের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হয়েছে। সামঞ্জস্য করতে গিয়ে শুধু সিরাজউদ্দৌলাকে ছোট করা হয়নি, মুসলমান এবং হিন্দু সম্প্রদায়, উভয়কেই ছোট করা হয়েছে। তা ছাড়া বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তরের মাধ্যমেও সৃজনশীলতা প্রদর্শন করা সম্ভব নয়। তারপর প্রথম উদ্দীপক প্রশ্নে (গদ্য) সবিতা নামের হিন্দু এক মেয়েকে নিয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে; দ্বিতীয় উদ্দীপকে অমিত বাবু নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ভূমি অফিসের নায়েবকে নিয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে; তৃতীয় উদ্দীপক প্রশ্নে একাত্তরকে নিয়ে আসা হয়েছে, যেখানে কাশেম নামে স্থানীয় রাজাকারের ইশারায় হিন্দু কেষ্টবাবুকে পাকিস্তানি মিলিটারের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়।

যার মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা শুধু এটাই জানবে যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে হিন্দুরা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছিল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ উদ্দীপক প্রশ্নে (খ বিভাগ) দুটি কবিতা, একটি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং অপরটি কবি সুফিয়া কামালের কবিতা- যেখানে বলা হয়েছে, কবি সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামীর নাম কি? কবি সুফিয়া কামালের স্বামীর খবর নেয়াটা কি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল? অষ্টম উদ্দীপক প্রশ্নে উপন্যাস সংশ্লিষ্ট। যেখানে বলা হয়েছে, জব্বার আলী নামে এক লোক স্বপ্নে এক কামেল পীরের মাজার খুঁজে পায় এবং পরে সেখানে মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। জব্বার আলী ওই মাজারের খাদেম হিসেবে নিয়োজিত হয়। গল্পটা পড়লে মনে হয়, দেশের মুসলমান সম্প্রদায় স্বপ্নে শুধু মাজার দেখে এবং পরে মাজার পূজার প্রচলন করে, যা উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্রে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে পদে পদে অবমাননা করার শামিল।
বোর্ডের প্রশ্ন যারা করেন তারা কোন্ মানের সেটিও সামনে এসেছে। এটি ঢাকা বোর্ডের প্রশ্ন এবং যে শিক্ষকই তা করুন না কেন, প্রশ্ন করা সম্পর্কে সেই শিক্ষকের  কোনো ধারণা নেই, সেটি প্রমাণিত হলো। এক বোর্ডের প্রশ্ন অন্য বোর্ডের শিক্ষকরা করেন। তা নিয়মে থাকলে তবে এত উদাসীনতা কেন?  মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, প্রশ্নকর্তা ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর সরকারী কলেজের একজন শিক্ষক, যিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, যা যশোর শিক্ষা বোর্ডের অন্তর্গত। এ প্রশ্ন একাধিক প্রশ্নকর্তার মধ্য থেকে বাছাই করা হয়, তারপর এটি মডারেট করতে হয়। কারোর চোখেই ধরা পড়েনি এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়টি। শিক্ষার অনেক ক্ষেত্রেই যে উদাসীনতা চলছে, সেটি কাজেই প্রমাণিত হচ্ছে বার বার।

যে উদ্দেশ্যে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, সেটি আদৌ পূরণ হচ্ছে কিনা, তা ভেবে দেখা উচিত। এই পদ্ধতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। পাশাপাশি, দরকার প্রশ্নপত্র তৈরিতে যোগ্য শিক্ষক প্রস্তুত ও যুক্ত করা। অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের মতো শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি কতটা যৌক্তিক, সেটিও আমাদের ভেবে দেখা উচিত। মেধাবীরা যাতে শিক্ষকতার পেশায় আসতে আগ্রহী হন, সেজন্য প্রাথমিক থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে শিক্ষকদের জন্য বেতন ও আর্থিক প্রণোদনায় বৈষম্য দূর করা বাঞ্ছনীয়। পরীক্ষা নিয়ে আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, চাই সফল বাস্তবায়ন। আর যারা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। সাম্প্রদায়িকতার শিকড় উপড়ে ফেলে জাতি গঠনে শিক্ষাকে মানবিক করা হোক, যা হবে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বড় প্রাপ্তি।

লেখক : গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সৃজনশীল প্রশ্ন বনাম সাম্প্রদায়িকতা

বিগত ৬ নভেম্বর থেকে সারাদেশে সব শিক্ষা বোর্ডের আওতায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে

বিগত ৬ নভেম্বর থেকে সারাদেশে সব শিক্ষা বোর্ডের আওতায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। উক্ত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা (আবশ্যিক) প্রথম প্রশ্নপত্রের প্রথমদিনেই সৃজনশীল নামক প্রশ্নপত্র নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। উল্লিখিত প্রশ্নপত্রের এগারো নম্বর প্রশ্ন নিয়ে মূলধারার মিডিয়াগুলো সর্বস্তরে সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগ উত্থাপিত করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই অভিযোগের পক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, এটি রীতিমতো ধর্মীয় উস্কানির শামিল। ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্র সৃজনশীল ১১ নম্বর প্রশ্নের ঘটনায় জাতি বিব্রত, যার ভেতর দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার একটি কুৎসিত চিত্র ফুটে উঠেছে, যা স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশে কাম্য নয়।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, দেশে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি নিয়ে যেমন সৃজনশীল প্রশ্ন শুরু হয়েছিল এক যুগেরও বেশি সময় অর্থাৎ ২০১০ সালে দেশে বাংলা প্রথম পত্র ও ধর্মশিক্ষা বিষয়ে। ২০১১ সাল থেকে সব বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি পরীক্ষা। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির অন্যতম সংগঠক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতে, ‘যেসব প্রশ্নের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মেধার জড়ত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃষ্টিক্ষম করে তোলা যায়, তার নামই সৃজনশীল প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে পাঠ্যবইয়ে লেখা তথ্য ও ভাবনাগুলো শুধু চিন্তাহীনভাবে মুখস্থ করলে চলবে না, সেগুলো ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং চারপাশের জীবন ও বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দৈনন্দিন জীবনে তার প্রয়োগ করতেও শিখতে হবে।’

এ জন্য প্রতিটি সৃজনশীল প্রশ্নকে ভাগ করা হয় চারটি অংশে। যেমন- প্রশ্নের চতুর্থ অংশে যাচাই করে দেখা হয়, ওই অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত পাঠ্যবইয়ের জায়গাটুকু ও উদ্দীপকের ভেতরকার ভাবনাচিন্তা, অনুভূতি-কল্পনাশক্তি, গভীরতা-ব্যাপকতা ইত্যাদিকে ছাত্রছাত্রীরা তুলনা করে বুঝতে পারছে কি না; এদের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা করে তার নিজস্ব মতামত গড়ে তুলতে পারছে কি না। এই চারটি অংশের মধ্যে প্রথম (জ্ঞানমূলক) এবং দ্বিতীয় (অনুধাবনমূলক) অংশটি পাঠ্যপুস্তক থেকে নেওয়া হয়। তৃতীয় (প্রয়োগমূলক) অংশে ‘উদ্দীপক’ নামক একটি ছোট গদ্যাংশ বা পদ্যাংশ অথবা ছবি, চার্ট, গ্রাফ ইত্যাদি যোগ করা হয়। যার উদ্দেশ্য থাকে উদ্দীপকের অংশ থেকে প্রশ্নের সঠিক প্রয়োগ। চতুর্থ অংশের উদ্দেশ্য পাঠ্যবই এবং উদ্দীপকের ভেতরের অংশের তুলনা করা (প্রথম আলো অনলাইন, ৩১ আগস্ট, ২০১৪)।
আমাদের দেশে বিগত একযুগেরও বেশি সময় ধরে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির বাস্তবায়ন সেভাবে হয়নি। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, সৃজনশীলতার জন্য যে সময় দরকার এবং চিন্তা করার প্রয়াস ঘটানো- এই দুটির কোনোটিই সম্ভব হয়নি কেবল শিক্ষকদের অদক্ষতার কারণে। এই পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে বিবেচনা করা উচিত ছিল সৃজনশীল প্রশ্ন করার জন্য একজন সৃজনশীল শিক্ষক দরকার। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকশিত করার সক্ষমতা একজন শিক্ষকের রয়েছে কি না, সেটাও মাথায় রাখা উচিত ছিল। এ নিয়ে শিক্ষকদের নানা প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরেও সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি, সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকরা দ্বিধাগ্রস্ত। এরই সুযোগ নিচ্ছে অনেক অশুভ শক্তি। যার একটি সহজ পাঠ হলো, যে কোনো একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার। যার একটি ক্ষেত্র হলো শিক্ষা খাত, শিক্ষক, পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ইত্যাদি।
সাম্প্রতিককালে দেশে শিক্ষকের নিগ্রহের /অবমাননার যত ঘটনা ঘটেছে, তার সবই ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষকদের কেন্দ্র করে। যেগুলো ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পদচারণ মাত্র, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এখন আসা যাক সৃজনশীলতার প্রসঙ্গটি নিয়ে, যা এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। যদি নিরপেক্ষ পর্যালোচনায় আসা যায় তা হলে দেখা যাবে যে, পুরো প্রশ্নপত্রই সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে পরিপূর্ণ। যে প্রশ্নকে সৃজনশীল বলা হচ্ছে, সে তো বিন্দুবিসর্গও সৃজনশীল নয়, বরং মুখস্থবিদ্যা কিংবা পুঁথিগত জ্ঞানকে পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দেওয়ার নামান্তর মাত্র। যেমন- মীরজাফর কোন্ দেশ হতে ভারতে আসেন; ‘ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব’- ব্যাখ্যা কর; উদ্দীপকের ‘নেপাল’ চরিত্রের সঙ্গে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ‘মীরজাফর’ চরিত্রের তুলনা কর এবং ‘খাল কেটে কুমির আনা’- প্রবাদটি উদ্দীপক ও ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য,-‘উক্তিটির সার্থকতা নিরূপণ কর। এর মধ্যে কী সৃজনশীলতা আছে, সেটি কারও বোধগম্য নয়।

মীরজাফর কোন্ দেশ থেকে ভারতে আসেন, সেটা জানার জন্য স্মৃতিশক্তি দরকার, সৃজনশীলতা নয়। এখানে নেপাল ও গোপাল নামে দুই ভাইয়ের গল্পকে কেন্দ্র করে সিরাজউদ্দৌলা নাটকের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হয়েছে। সামঞ্জস্য করতে গিয়ে শুধু সিরাজউদ্দৌলাকে ছোট করা হয়নি, মুসলমান এবং হিন্দু সম্প্রদায়, উভয়কেই ছোট করা হয়েছে। তা ছাড়া বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তরের মাধ্যমেও সৃজনশীলতা প্রদর্শন করা সম্ভব নয়। তারপর প্রথম উদ্দীপক প্রশ্নে (গদ্য) সবিতা নামের হিন্দু এক মেয়েকে নিয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে; দ্বিতীয় উদ্দীপকে অমিত বাবু নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ভূমি অফিসের নায়েবকে নিয়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে; তৃতীয় উদ্দীপক প্রশ্নে একাত্তরকে নিয়ে আসা হয়েছে, যেখানে কাশেম নামে স্থানীয় রাজাকারের ইশারায় হিন্দু কেষ্টবাবুকে পাকিস্তানি মিলিটারের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়।

যার মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা শুধু এটাই জানবে যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে হিন্দুরা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছিল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ উদ্দীপক প্রশ্নে (খ বিভাগ) দুটি কবিতা, একটি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং অপরটি কবি সুফিয়া কামালের কবিতা- যেখানে বলা হয়েছে, কবি সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামীর নাম কি? কবি সুফিয়া কামালের স্বামীর খবর নেয়াটা কি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল? অষ্টম উদ্দীপক প্রশ্নে উপন্যাস সংশ্লিষ্ট। যেখানে বলা হয়েছে, জব্বার আলী নামে এক লোক স্বপ্নে এক কামেল পীরের মাজার খুঁজে পায় এবং পরে সেখানে মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। জব্বার আলী ওই মাজারের খাদেম হিসেবে নিয়োজিত হয়। গল্পটা পড়লে মনে হয়, দেশের মুসলমান সম্প্রদায় স্বপ্নে শুধু মাজার দেখে এবং পরে মাজার পূজার প্রচলন করে, যা উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্রে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে পদে পদে অবমাননা করার শামিল।
বোর্ডের প্রশ্ন যারা করেন তারা কোন্ মানের সেটিও সামনে এসেছে। এটি ঢাকা বোর্ডের প্রশ্ন এবং যে শিক্ষকই তা করুন না কেন, প্রশ্ন করা সম্পর্কে সেই শিক্ষকের  কোনো ধারণা নেই, সেটি প্রমাণিত হলো। এক বোর্ডের প্রশ্ন অন্য বোর্ডের শিক্ষকরা করেন। তা নিয়মে থাকলে তবে এত উদাসীনতা কেন?  মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, প্রশ্নকর্তা ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর সরকারী কলেজের একজন শিক্ষক, যিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, যা যশোর শিক্ষা বোর্ডের অন্তর্গত। এ প্রশ্ন একাধিক প্রশ্নকর্তার মধ্য থেকে বাছাই করা হয়, তারপর এটি মডারেট করতে হয়। কারোর চোখেই ধরা পড়েনি এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়টি। শিক্ষার অনেক ক্ষেত্রেই যে উদাসীনতা চলছে, সেটি কাজেই প্রমাণিত হচ্ছে বার বার।

যে উদ্দেশ্যে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, সেটি আদৌ পূরণ হচ্ছে কিনা, তা ভেবে দেখা উচিত। এই পদ্ধতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। পাশাপাশি, দরকার প্রশ্নপত্র তৈরিতে যোগ্য শিক্ষক প্রস্তুত ও যুক্ত করা। অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের মতো শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি কতটা যৌক্তিক, সেটিও আমাদের ভেবে দেখা উচিত। মেধাবীরা যাতে শিক্ষকতার পেশায় আসতে আগ্রহী হন, সেজন্য প্রাথমিক থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে শিক্ষকদের জন্য বেতন ও আর্থিক প্রণোদনায় বৈষম্য দূর করা বাঞ্ছনীয়। পরীক্ষা নিয়ে আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, চাই সফল বাস্তবায়ন। আর যারা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। সাম্প্রদায়িকতার শিকড় উপড়ে ফেলে জাতি গঠনে শিক্ষাকে মানবিক করা হোক, যা হবে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বড় প্রাপ্তি।

লেখক : গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা